কোরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক বার্তা প্রচার করাই এই ওয়েবসাইটের মূল উদ্দেশ্য।।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আয়েশা রা. এর মাঝে ভালবাসার বন্ধন উটের রশির গিঁটের মতো মজবুত সংক্রান্ত হাদিসটি বানোয়াট

বর্তমানে ফেসবুক পাড়ায় এ সংক্রান্ত একটি হাদিস খুব চর্চা হচ্ছে। অনেকেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝের গভীর ভালবাসা এবং সম্পর্কের দৃঢ়তার বিষয়টি বুঝাতে প্রমাণ হিসেবে এটি উল্লেখ করে থাকে এবং গণহারে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ ও টাইমলাইনে কপি-পেস্ট করে থাকে। অথচ তারা এর সত্যতা যাচায়ের প্রয়োজন অনুভব করে না!

যাহোক নিম্নে প্রচলিত এ হাদিসটি উল্লেখ পূর্বক তার মানের ব্যাপারে বিজ্ঞ হাদিস বিশারদগণের অভিমত এবং এর অর্থগত দিকটি তুলে ধরা হলো:

➤ প্রচলিত হাদিসটি নিন্মরূপ:

يا رسولَ اللهِ : كيفَ حُبُّكَ لي ؟ قال : كعُقدةِ الحبلِ, قال : فكُنْتُ أقولُ لهُ : كيفَ العُقدةُ ؟ فيقولُ : على حالِها

একবার আয়েশা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
রসুলুল্লাহহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসি।
আয়েশা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, আমার প্রতি আপনার ভালোবাসাটা কেমন?
তিনি বললেন, উট-বাঁধা রশির গিঁটের মতো। (বাংলায় যাকে বলে আন্ধা গিটঠু)
এরপর মাঝেমাঝেই আয়েশা রা. জিজ্ঞাসা করতেন, আপনার সেই ভালোবাসার গিঁটের খবর কী?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, তা আগের মতোই বহাল আছে।”

❑ হাদিসটির মানের বিষয়ে সংক্ষেপে বিজ্ঞ মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশারদগণের সনদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো:

◍ এ হাদিসটি ইবনে ইরাক তার তানযীহুশ শারীয়াহ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ২৫১ পৃষ্ঠায় ইমাম দারাকুতনি সূত্রে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, باطل وفي سنده متروكون “ এটি বাতিল (বানোয়াট) হাদিস, এর সনদে কয়েকজন মাতরূক (পরিত্যক্ত) বর্ণনাকারী রয়েছে।” [লিসানুল মিযান, ১/৫৭১]

◍ ভারত উপমহাদেশে ১৫ শতকের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ আল ফাত্তানি এ হাদিসটিকে তার ‘তাযকিরাতুল মাউযুআত’ শীর্ষক বানোয়াট হাদিস সংকলন গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেন, هو حديث باطل فيه ضعفاء “এটি বাতিল (বানোয়াট) হাদিস। এর বর্ণনা সূত্রে একাধিক দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছে।

➤ অর্থগতভাবেও এটি দুর্বল। কারণ রশির গিঁটও খোলা যায়। এর দ্বারা ভালবাসা ও সম্পর্কের স্থায়িত্ব যথার্থভাবে প্রকাশিত হয় না। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে কখনো তালাক দিবেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন। যেমন: বিখ্যাত এগারো নারীর হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে বলেছেন,
يَا عَائِشَةُ، كُنْتُ لَكِ كَأَبِي زَرْعٍ لأُمِّ زَرْعٍ، إِلاّ أَنَّ أَبَا زَرْعٍ طَلَّقَ، وَأَنَا لا أُطَلِّقُ. رواه الطبراني بهذا اللفظ، وأصله في الصحيحين
“হে আয়েশা, আবু যারয়া তার স্ত্রী উম্মে যারযার প্রতি যেরূপ আমিও তোমার প্রতি তদ্রূপ (তবে পার্থক্য হল), আবু যারয়া উম্মে যারয়াকে তালাক দিয়েছিলো। কিন্তু আমি তোমাকে তালাক দিবো না।” [তাবারানিতে এই শব্দে বর্ণিত হয়েছে। আর মূল হাদিসটি রয়েছে বুখারি ও মুসলিমে]

মোটকথা, হাদিস ও সিরাতের কিতাবগুলোতে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. এবং প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাঝের মধুময় সম্পর্ক ও গভীর প্রেম-ভালবাসার বিষয়টি অত্যন্ত সুবিদিত। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ সে বিষয়েও পর্যাপ্ত সহিহ হাদিস রয়েছে। তাই আমাদের কর্তব্য, সেগুলো অধ্যয়ন করা, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা এবং যথাসাধ্য সেগুলোর প্রচার ও প্রসার করা। কিন্তু মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ছাড়া হাদিসের নামে এসব বাতিল, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন চটকদার গল্প-কাহিনী ও কথাবার্তা বর্ণনা করা বা প্রচার করা জায়েজ নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং দিব্যজ্ঞানের আলোকে পথ পথচলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬ ◉◯◉ ▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।