রামাদানে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আমরা কী কী কাজ করতে পারি

কুরআন নাজিলের মাস রামাদান। অতএব
এই রামাদানে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আমরা কী কী কাজ করতে পারি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিশ্ব মানবতার চিরন্তন সংবিধান। এটি মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ পথনির্দেশিকা। অভ্রান্ত সত্যের চুড়ান্ত মাপকাঠি। পৃথিবীর ইতিহাসে আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যেখানে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোনরূপ সন্দেহ নেই।’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২)। সামনে-পিছনে, ডানে-বামে তথা কোনদিক থেকে তাতে মিথ্যা প্রবেশের কোনই সুযোগ নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘মিথ্যা এর নিকটে সামনে না পিছনে কোন দিক দিয়ে আসতে পারে না। ইহা অবতীর্ণ হয়েছে মহাজ্ঞানী, সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে। (সূরা ফুসসিলাত: ৪২)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,‘সততা ও ইনসাফের দিক দিয়ে আপনার প্রতিপালকের বাণী (আল-কুরআন) পরিপূর্ণ। তাঁর বাণী পরিবর্তন করার সাধ্য কারোর নেই। আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আল-আন‘আম: ১১৫)।
.
রামাদান হল কুরআন নাযিলের মাস।
_________________________________
মহান আল্লাহ পবিত্র রামাদান মাসে কুরআনুল কারীম নাযিল করেন বিধায় এমাসে কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব-মর্যাদাও অনেক বেশী। এমর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সুতরাং যে ব্যক্তি রামাদান মাস পায়; সে যেন সিয়াম পালন করে। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৫)। আর অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘আমি তা নাযিল করেছি ক্বদরের রাতে।’ (সূরা আল-ক্বদর: ১)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয় আমি ইহা নাযিল করেছি এক বরকতময় রাত্রিতে; নিশ্চয় আমরা সতর্ককারী।’ (সূরা আদ-দুখান: ৪)। আর বরকতময় রাত্রি হচ্ছে কদরের রাত্রি। যা রামাদান মাসেই সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন; কদরের রাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা আল-ক্বদর: ৩)। আর দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, লায়লাতুল ক্বদর কেবলমাত্র রামাদান মাসেই হয়েই থাকে। এ কারণেই রামাদান সর্বাধিক মহিমান্বিত মাস।
.
নুযূলে কুরআন বা কুরআন নাজিল শুরু হয় হেরা গুহায় ২১রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রিতে। প্রথম পাঁচটি আয়াত (সূরা আল-আলাক্ব: ১-৫)। আহালুল আলেমগন বলেন; সেদিন পাঁচটি আয়াত নাযিল করে সম্মানিত ফেরেশতা জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) চলে যান। খৃষ্টীয় হিসাবে এ দিনটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন। (আল্লাহু আলাম)(বিস্তারিত দেখুন- ইমাম সফিউর রহমান মুবারকপুরী, রহ; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৬৬-৬৭, টীকাসহ আলোচনা দ্রষ্টব্য; তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, পৃ. ৩৬৮)। কুরআনুল কারীমকে একই সাথে প্রথম আকাশের উপরে রামাদান মাসের ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করা হয় এবং ঐ রাতকে বরকতময় রাতও বলা হয়। (তাফসীর ইবনু কাছীর, ১ম খ-, সূরা বাক্বারাহ-এর ১৮৫-নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহ কুরআনকে ক্বদরের রাতে দুনিয়ার আসমানে একসাথে নাযিল করেন। অতঃপর তাঁর রাসূলের নিকট একের পর এক নাযিল করেন। (মুসতাদরাক আলাছ সহীহাঈন লিল হাকিম মা‘আ তালিকাতিয যাহাবী, ২য় খ-, পৃ. ৫৭৮)। জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃ. ৯১১ হি.) বলেন, ‘আল্লাহ কুরআনকে একসাথে ক্বদরের রাতে দুনিয়ার আসমানে নাযিল করেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুপাতে তা দুনিয়ায় নাযিল করেন।’ (জালালুদ্দীন আবুবাকর আস-সুয়ূত্বী, আল-ইতক্বান, ১ম খ-, পৃ. ৮৯)
.
🔹কুরআন নাযিলের পটভুমি:
____________________________
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিলের বছরে রবীউল আউয়াল মাস থেকে রাসূল (ﷺ) সত্যস্বপ্ন দেখতে থাকেন। ছ’মাস পর রামাদান মাসে তিনি হেরা গুহাতে ই‘তিকাফ করেন। অতঃপর শেষ দশকে ক্বদর রাতে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। যা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ২৩ বছরে শেষ হয়। এজন্য তাঁর সত্য স্বপ্নকে নবুঅতের ৪৬ ভাগের একভাগ বলা হয়। (সহীহ বুখারী, হা/৬৯৮৯; সহীহ মুসলিম, হা/২২৬৩)। হাদীসে এসেছে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ঘুমন্ত অবস্থায় সত্যস্বপ্নের মাধ্যমে ‘অহী’ নাযিলের সূচনা হয়। স্বপ্নে তিনি যা দেখতেন, প্রভাত সূর্যের মত তা সত্য হয়ে দেখা দিত। এরপর তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা দেখা দেয়। তখন তিনি হেরা গুহায় গিয়ে রাত কাটাতে থাকেন। তিনি একত্রে কয়েকদিনের খাদ্য সাথে নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে ফিরে এসে আবার খাদ্য নিয়ে যেতেন। এইভাবে একরাতে তাঁর নিকটে হেরা গুহাতে সত্য এসে হাযির হলো। ফেরেশতা তাঁকে বলল, তুমি পড়। রাসূল (ﷺ) বললেন, مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। রাসূল (ﷺ) বলেন, তখন ফেরেশতা আমাকে বুকে ধরে জোরে চাপ দিল। তাতে আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। তখন বলল, ‘পড়’। বললাম, ‘পড়তে জানি না’। এবার দ্বিতীয়বার চাপ দিয়ে বলল ‘পড়’। বললাম, পড়তে জানি না। অতঃপর তৃতীয়বার চাপ দিয়ে বলল, اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’- এখান থেকে পরপর পাঁচটি আয়াত। রাসূল (ﷺ) পাঠ করলেন। তারপর ফেরেশতা চলে গেল এবং রাসূল (ﷺ) বাড়ীতে ফিরে এলেন। এ সময় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি খাদিজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِىْ زَمِّلُوْنِىْ ‘আমাকে চাদর মুড়ি দাও! আমাকে চাদর মুড়ি দাও’। অতঃপর চাদর মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর তিনি বললেন, يَا خَدِيْجَةُ مَا لِىْ ‘খাদিজা আমার কি হলো?’ তারপর তিনি সব খুলে বললেন এবং শেষে বললেন, قَدْ خَشِيْتُ عَلَىَّ ‘আমি মৃত্যুর আশংকা করছি’। তখন খাদিজা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,কখনোই না। সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লজ্জিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সত্য কথা বলেন, গরীবের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথি সেবা করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন। অতঃপর খাদীজা তাঁকে নিয়ে চাচাতো ভাই ওয়ারাক্বা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে ‘নাসারা’ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরবী লিখতে পারতেন এবং ইনজীল থেকে আরবী করতেন। তিনি অতি বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদিজা তাকে বললেন, ভাই দেখুন আপনার ভাতিজা কি বলছেন। ওয়ারাক্বা বললেন, বলো ভাতিজা, কি দেখেছ? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে সব খুলে বললেন, যা তিনি দেখেছেন। জওয়াবে ওয়ারাক্বা বললেন, এতো সেই ফেরেশতা যিনি মূসার উপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন যুবক থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম। যেদিন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে বহিষ্কার করবে। একথা শুনে রাসূল (ﷺ) বলে উঠলেন أَوَمُخْرِجِىَّ هُمْ ؟ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দেবে?’ ওয়ারাক্বা বললেন, نَعم، لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلَّا عُوْدِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি। সহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় إِلَّا أُوْذِىَ ‘যিনি নির্যাতিত হননি’ এসেছে। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৫৩)। অতঃপর তিনি বললেন, إِنْ يُدْرِكْنِىْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করব’। এর কিছু দিনের মধ্যেই ওয়ারাক্বা মৃত্যুবরণ করেন।(নোট আল ইখলাস থেকে)
.
🔹অধিক কুরআন তেলাওয়াতের মাস রামাদান:
_______________________________________
সর্বাধিক কুরআন তেলাওয়াতের মাস রামাদান। প্রত্যেক রামাদানে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কুরআন মাজীদ শুনাতেন। তাই তিনিও এ মাসে অধিক হারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এমর্মে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিক দানশীল ছিলেন। যখন জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) রামাযানে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি আরও বেশি দান করতেন। কারণ রামাদানের প্রতি রাতে তিনি জিব্রীল (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং প্রবাহিত বাতাসের ন্যায় অধিকহারে দান করতেন।(সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; নাসাঈ, হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৪২৫; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৪৪০; মিশকাত, হা/২০৯৮)
.
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘প্রতি বছর জিব্রীল নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে একবার কুরআন মাজীদ শোনতেন ও শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তার ওফাত হয়, সে বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দু’বার শুনিয়েছেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৬৯; মিশকাত, হা/২০৯৯)। রামাদান মাসে কুরআন নাযিল হয়। আর এই রামাদানেই পুরো কুরআন মাজীদ জিব্রীল নবী করীম (ﷺ)-কে শোনতেন ও শোনাতেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ এ মাসে অধিকহারে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করতেন। তাই আমাদের প্রত্যেক রামাদান মাসে বেশি বেশি কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা উচিত।
.
🔹সিয়ামের সাথে কুরআনের রয়েছে নিবীড় সম্পর্ক:
_______________________________________
রামাদানের সিয়াম ও কুরআন মাজীদের মধ্যে নিবীড় সম্পর্ক। এ দু‘টির কারণেই রামাদান এতো অধিক ফযীলতপূর্ণ মাস। ক্বিয়ামতের দিন সুপারিশের ব্যাপারেও তারা একে অপরের পরিপূরক। কারণ, রামাদানের সিয়াম ক্বিয়ামতের ভয়াবহ মুহূর্তে সিয়াম পালনকারী বান্দার জন্য যেমন সুপারিশ করবে। তেমনি কুরআনও তার পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে। একাধিক বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে, যেমন; আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে প্রভু! আমি আপনার বান্দাকে দিনের বেলায় যাবতীয় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম হতে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর দু’জনের সুপারিশ কবুল করা হবে।(বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৩৯; হাকেম, হা/২০৩৬; মিশকাত, হা/১৯৬৩; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪২৯, সনদ সহীহ)। হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী হানাফি রহ: বলেন, হতে পারে রামাদানের সুপারিশ হবে গুণাহ ক্ষমা করার জন্য এবং কুরআনের সুপারিশ হবে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। (মিশকাতুল মাসাবিহ হা ১৯৬৩ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। অপর বর্ননায় জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘এই কুরআন (ক্বিয়ামতে) সুপারিশকারী; তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে। (কুরআন) সত্যায়িত প্রতিবাদী। যে ব্যক্তি তাকে নিজের সামনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জান্নাতের প্রতি পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তাকে পিছনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে।’ (সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/১২৪; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৫৫; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/৮৬৫৫; মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩০৬৭৭; কানযুল উম্মাল, হা/২৩০৬;সহীহ আত-তারগীব, হা/১৪২৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২০১৯, সনদ সহীহ)
.
▪️এই রামাদানে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আমরা যেসব কাজ করতে পারি:
______________________________
(১). রামাদানে কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আমাদের প্রথম কাজ হবে পবিত্র কুরআন বিশুদ্ধভাবে পড়তে শেখা। শুরুতে একদম হাফেজদের মতো হওয়া জরুরি নয়, মোটামুটি বেসিক বিষয়গুলো শুদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট, যেন এমন উচ্চারণ না হয় যে- অর্থই বদলে যায়। অর্থাৎ হরফগুলোর বিশুদ্ধ উচ্চারণ জেনে নিতে হবে। তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করতে অবহেলা করা যাবে না। তবে কুরআন সঠিকভাবে তেলাওয়াতের জন্য তাজবীদ শিক্ষা করা একান্ত জরূরী। কেননা আল্লাহ বলেন, তুমি কুরআন পাঠ কর ধীরে ধীরে। (সূরা মুযযাম্মিল; ৭৩/৪)। ‘তারতীল’ অর্থ সুশৃংখল ভাবে যথানিয়মে পাঠ করা। উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী (ﷺ) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- তোমাদের মধ্যে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিক্ষা করে ও তা অপরকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী, হা/৫০২৭)
.
(২). মুসহাফ তথা কুরআনের আরবী কপি ধরতে অজু থাকা জরুরি। তবে, মোবাইলে পড়তে অজু জরুরি নয়। এটিই বিশুদ্ধ মত। সুতরাং গোসল ফরয হওয়া, হায়েয, নেফাস ইত্যাদি অবস্থায় মূল কপি কুরআন স্পর্শ না করে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবে। তবে সর্বদাই পবিত্র অবস্থায় তেলাওয়াত করা উত্তম। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন; ‘নবী (ﷺ) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি ঋতুবতী অবস্থায় ছিলাম।’ (সহীহ বুখারী, হা/২৯৭;সহীহ মুসলিম, হা/৩০১)। আম্মা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ) সর্বাবস্থায় মহামহিয়ান আল্লাহর যিকির করতেন।’ (সহীহ মুসলিম, ‘হায়েয’ অধ্যায়, ‘অপবিত্র ও অন্যান্য অবস্থায় মহান আল্লাহর যিকর করা প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ ৩/৩০, হা/৩৭৩, ৭১২; তা‘লীকুল বুখারী, হা/৬৩৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৮৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪১০, ২৫২০০)। এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে- নবী (ﷺ) পবিত্র, অপবিত্র, ওযূ অবস্থায়, ওযূবিহীন অবস্থায়, বসে, দাঁড়িয়ে, হেলান দিয়ে, হাঁটা ও আরোহী সকল অবস্থায়ই আল্লাহর যিকর করতেন। এখানে যিকর কথাটি ‘আম’ তথা ব্যাপক অর্থবোধক, যা তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ, ইস্তিগফার, দরূদ সকল প্রকার যিকর শামিল করে।
.
(২). যদি তিলাওয়াত সহীহ হয়, তবে পুরো রামাদানে অন্তত একবার কুরআন খতম দেওয়ার চেষ্টা করবো। এটা কুরআনের হক। তবে ৪০ দিনে খতম করতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘‘তুমি (অন্তত) ৪০ দিনে কুরআন পাঠ (শেষ) করবে।’’ (ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৯৪৭)। সুতরাং বেশি বা দ্রুত খতমের আকাঙ্ক্ষায় এমনভাবে তিলাওয়াত করবেন না যে, পড়া সহীহ হয় না। এতে তেমন ফায়দা হবে না। যেটুকু পড়বেন, ধীরে-সুস্থে, আগ্রহ সহকারে, ভালোবাসা নিয়ে পড়বেন। পরিমাণ কম হলেও আল্লাহ এতে বেশি খুশি হবেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; কুরাআন পাঠে দক্ষ ব্যাক্তি উচ্চ মযাদা সম্পন্ন ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যাক্তি কুরাআন পড়ার সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম আবু দাউদ হা/১৪৫৪)
.
(৩). সম্ভব হলে অর্থসহ একবার পড়তে চেষ্টা করবো। কেননা এসব আল্লাহর নির্দেশ। যার অর্থ বুঝে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা জরূরী। আর তেলাওয়াকারীকে চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ এ কুরআনে বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করেছেন। সেজন্য আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে যথাযথভাবে বুঝে তা প্রতিপালন করা আবশ্যক। আর আদেশ-নিষেধ অনুধাবন করা কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাছাড়া অর্থ বুঝে তিলাওয়াতের মর্যাদা অনেক বেশি। তবে, শুধু তিলাওয়াতেও নেকি হয়। এ ব্যাপারে হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। সাধারণভাবে তেলোয়াতের পাশাপাশি প্রতিদিন কিছুটা সময় হলেও অনুবাদ অথবা তাফসিরসহ পড়ার চেষ্টা করবেন। এটি কুরআনের দাবি। সেক্ষেত্রে সহজ অনুবাদ হিসেবে কাশফুল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বায়ান ফাউন্ডেশনের অনুবাদ কিংবা ড. আবু বকর মোহাম্মদ জাকারিয়া স্যারের সংক্ষিপ্ত তাফসীরটি পড়া যেতে পারে। দেশের অনেক শীর্ষ আলিমের তত্ত্বাবধানে এ দুটো অনুবাদ হয়েছে।
.
(৪). কুরআন তেলোয়াত করার পাশাপাশি কুরআন নিয়ে গবেষণা এবং আয়াতের মর্ম বুঝার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন; তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। (সূরা আন-নিসা: ৮২)। মহান আল্লাহ বলেন, তারা তবে কি কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে? (সূরা মুহাম্মাদ: ২৪)। তিনি আরো বলেছেন- যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতোপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারপর তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে গেল। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক।’ (সূরা আল-হাদীদ: ১৬)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে বললেন, তুমি আমার সামনে কুরআন পড়। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনার সামনে আমি কুরআন পড়ব! অথচ এটা আপনার উপরই নাযিল হয়েছে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হ্যাঁ। সুতরাং আমি সূরা ‘আন-নিসা’ পড়তে আরম্ভ করলাম। যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলাম তবে কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মতের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে এদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব।’ (সূরা আন-নিসা: ৪১), তখন তিনি বললেন, এবার বন্ধ করো। এ সময় আমি তাঁর দিকে তাকালাম; দেখি তাঁর দুই চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। (সহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; সহীহ মুসলিম, হা/৮০০)
.
(৫). সংক্ষিপ্ত কোনো তাফসীর পড়তে চাইলে দেশের শীর্ষ আলেম শাইখ ড. আবু বকর যাকারিয়া (হাফি.) Abubakar Muhammad Zakaria (হাফেজাহুল্লাহ) সংকলিত ৫ খণ্ডের ‘‘আল কুরআনুল কারীম বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর’’ পড়তে পারি। সবুজ উদ্যোগ প্রকাশনী থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে যারা নতুন এবং কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে চান তাদের জন্য স্যারের তাফসীরটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাকি তাফসীর গুলোতে ছোটখাট ভুল এবং জাল জয়ীফ হাদিস রয়েছে তাই প্রাথমিক লেভেলে স্যারের তাফসীরটি পড়তে পারেন। কারণ আলহামদুলিল্লাহ বাংলা ভাষায় রচিত (প্রধানত সংকলিত) এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য তাফসির এটি।
.
(৬). কুরআন তেলোয়াতের সময় সিজদার আয়াত পড়লে সিজদাহ দেওয়া। জেনে রাখা ভাল,কুরআনে মোট ১৫ টি সিজদার আয়াত আছে। যথা: আ‘রাফ ২০৬, রা‘দ ১৫, নাহল ৫০,বনি ইসরাঈল ১০৯, মারিয়াম ৫৮, হজ্জ ১৮, ৭৭, ফুরক্বান ৬০, নমল ২৬, সাজদাহ ১৫, সোয়াদ ২৪, ফুসসিলাত/হামীম সাজদাহ ৩৮, নাজম ৬২, ইনশিক্বাক্ব ২১, ‘আলাক্ব ১৯ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭; হাকেম ২/৩৯০-৯১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৫)। এ আয়াতগুলি পড়লে বা শ্রবণ করলে সিজদা দেয়া সুন্নাত। ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) সিজদার আয়াত পড়তেন এবং সিজদা করতেন। আমরাও সিজদার জন্য ভিড় জমাতাম। এমনকি অনেকে ভিড়ের কারণে সিজদা দেয়ার জায়গা পেত না (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১০২৫) তাই আয়াতগুলো পাঠ করা মাত্রই তাশাহুদ, সালাম ছাড়াই একটি সিজদা দিন। তবে না দিলেও গুনাহ হবেনা ইনশাআল্লাহ। কারন যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-এর সামনে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা না করলে রাসূল (ﷺ) ও সিজদা দেননি। (আবু দাউদ হা/১৪০৪; তিরমিযী হা/৫৭৬; দারেমী হা/১৪৭২, সনদ সহীহ)।
.
(৭). কুরআন খতমের পর বিশেষ কোনো দু‘আ সহীহ কোনো হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত নয়। সুতরাং, কোরআন খতমের নামে সমাজে যে দোয়া গুলো প্রচলিত আছে সেগুলো বর্জনীয়। তবে স্বাভাবিক ভাবে কুরআন তেলাওয়াত বা যেকোন দ্বীনি বৈঠক শেষে নিম্নলিখিত দোয়া পাঠ করা যায়। আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন মাজলিসে (বৈঠকে) বসতেন তখন কিছু বাক্য উচ্চারণ করতেন। একদিন আমি ঐ সব কালাম সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, (মাজলিসে) যদি কল্যাণকামী আলোচনা হয় তবে তা তার জন্য কিয়ামাত পর্যন্ত ‘মুহর’ হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি (মাজলিসে) অকল্যাণকর আলোচনা হয় তবে তা তার জন্য কাফফারার মধ্যে গণ্য হবে। কালামটি হলো, سُبْحَانَ وَبِحَمْدِكَ لَا إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ উচ্চারণ : সুব্হা-নাকা ওয়া বিহাম্দিকা লা ইলা-হা ইল্লা আংতা আস্তাগ্ফিরুকা ওয়া আতূবু ইলায়কা। অর্থ : ‘পবিত্রতা সহ আপনার প্রশংসা বর্ণনা করছি। আপনি ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তওবা করছি।।’ (ইমাম নাসাঈ, আল-কুবরা হা/১০১৪০; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হা/৩০৮, সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৩১৬৪; দ্রঃ নাসাঈ; বৈরুত: দারুল মা‘আরিফাহ ১৯৯৭, হা/১৩৪৪)
.
পরিশেষে বলা যায় যে, রামাদান কুরআন নাজিলের মাস। এমাসে বেশি বেশি কুরআন তেলোয়াত করা এবং কুরআন শিক্ষা করা এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করা মুমিনের জন্য জরূরী। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা ও রামাদানের প্রতিদিন কমপক্ষে এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করা কর্তব্য। যা মুখস্থ আছে তা সংরক্ষিত রাখা ও আয়াতগুলির অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা, সেইসাথে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সার্বিক জীবন গঠন করা কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: