রাতের স্বলাত ও তাহাজ্জুদ স্বলাতের নিয়ম

রাতের স্বলাত ও তাহাজ্জুদ স্বলাতের নিয়ম ও ফজীলত
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষ
শায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন

রাতে ঘুম থেকে উঠে স্বলাত আদায়কে ‘তাহাজ্জুদ’ বলে। মূলতঃ তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামুল লায়েল, তারাবীহ, ক্বিয়ামে রামাযান সবই ‘স্বলাতুল লায়েল’ বা রাতের স্বলাত। রাতের শেষ অংশে পড়লে তাকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয় এবং প্রথম অংশে পড়লে ‘তারাবীহ’ বলা হয়। প্রথম রাতে তারাবীহ পড়লে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে হয় না। রাসূল (ﷺ) একই রাত্রে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টিই পড়েছেন মর্মে কোন প্রমাণ নেই।[1]

রাসূল (ﷺ) তাহাজ্জুদের স্বলাতে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে ইমরানের ১৯০ আয়াত থেকে সূরার শেষ অর্থাৎ

২০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করতেন। অতঃপর মিসওয়াক করে ওযূ করতেন।[2] স্বলাত শুরু করার পূর্বে ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’, সুবহানাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী, সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযূবিকা মিন যীকিদ্দুনিয়া ওয়া মিন যীক্বি ইয়াওমিল ক্বিয়ামাহ’ বলতেন। উক্ত বাক্যগুলো প্রত্যেকটিই দশবার দশবার করে বলতেন।[3] নিম্নের দু‘আটিও পড়া যায়। তবে আরো দু‘আ আছে।[4]

لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لآ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ ِللهِ وَلآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلآ حَوْلَ وَلآ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ.

উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু। লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াল হামদু লিল্লা-হি ওয়ালা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার; ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ। অতঃপর বলবে, ‘রবিবগফির্লী’।[5] উল্লেখ্য যে, রাসূল (ﷺ) তাহাজ্জুদের স্বলাতে বিভিন্ন ‘ছানা’ পড়েছেন।[6]

তাহাজ্জুদ স্বলাতের নিয়ম :

(ক) তাহাজ্জুদ শুরু করার পূর্বে দু’রাক‘আত সংক্ষিপ্তভাবে পড়ে নিবে।[7] (খ) অতঃপর দুই দুই রাক‘আত করে ৮ রাক‘আত পড়বে এবং শেষে একটানা তিন রাক‘আত বিতর পড়বে, মাঝে বৈঠক করবে না।[8] অথবা দুই দুই রাক‘আত করে দশ রাক‘আত পড়বে। শেষে এক রাক‘আত বিতর পড়বে।[9] রাসূল (ﷺ) নিয়মিত উক্ত পদ্ধতিতেই স্বলাত আদায় করতেন। তবে কখনো কখনো বিতর স্বলাতের সংখ্যা কম বেশী করে রাতের স্বলাতের রাক‘আত সংখ্যা কম বেশী করতেন। কারণ রাতের পুরো স্বলাতই বিতর। দুই রাক‘আত করে পড়ে শেষে এক রাক‘আত পড়লেই সব বিতর হয়ে যায়।[10] আর তিনি ১৩ রাক‘আতের বেশী পড়েছেন মর্মে কোন সহিহ দলীল পাওয়া যায় না।[11] (গ) যদি কেউ প্রথম রাতে এশার পরে বিতর পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে শেষ রাতে শুধু তাহাজ্জুদ পড়বে। তখন আর বিতর পড়তে হবে না। কারণ এক রাতে দুইবার বিতর পড়তে হয় না।[12] (ঘ) বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে সকালে অথবা যখন স্মরণ বা সুযোগ হবে, তখন পড়ে নেয়া যাবে’।[13] (ঙ) যদি কেউ আগ রাতে বিতরের পর দু’রাকআত নফল স্বলাত আদায় করে এবং শেষরাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে সক্ষম না হয়, তাহলে উক্ত দু’রাক‘আত স্বলাত তার জন্য যথেষ্ট হবে’।[14] (চ) রাতের নফল স্বলাত নিয়মিত আদায় করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তুমি ঐ ব্যক্তির মত হয়ো না, যে রাতের নফল স্বলাতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়েছে’।[15] নিয়মিত রাতের স্বলাত আদায়কারী ব্যক্তি বিতর পড়ে শুয়ে গেলে এবং ঘুম বা অন্য কোন কারণে তাহাজ্জুদ পড়তে না পারলে দিনের বেলায় দুপুরের আগে তা পড়ে নিতে পারবে।[16] (ছ) তাহাজ্জুদ স্বলাতে ক্বিরাআত কখনো সশব্দে কখনো নিঃশব্দে পড়া যায়।[17]

[1]. মুসলিম হা/১৭১৮, ১/২৫৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৫৫৫), ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; বুখারী হা/২০১০, ১/২৬৯ পৃঃ; মিশকাত হা/১৩০১, পৃঃ ১১৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২২৭, ৩/১৫১ পৃঃ; আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, আল-আরফুয যাশী শরহে তিরমিযী ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৬; ফায়যুল বারী ২য় খন্ড, পৃঃ ৪২০; মির‘আত ৪/৩১১ পৃঃ, হা/১৩০৩-এর আলোচনা দ্রঃ, ‘স্বলাত’ অধ্যায়, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী হা/১১৯৮, ১/১৫৯ পৃঃ; মুসলিম হা/১৮৩৫, ১/২৬০ পৃঃ; মিশকাত হা/১১৯৫, পঃ ১০৬, ‘স্বলাত’ অধ্যায়, ‘রাতের স্বলাত’ অনুচ্ছেদ।
[3]. আবুদাঊদ হা/৭৬৬, ১/১১১ পৃঃ, সনদ সহিহ; মিশকাত হা/১২১৬, পৃঃ ১০৮।
[4]. মুসলিম হা/১৮৩৫, ১/২৬০ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬৫৮); মিশকাত হা/১১৯৫, পৃঃ ১০৬; আবুদাঊদ হা/৮৭৪; মিশকাত হা/১২০০।
[5]. বুখারী হা/১১৫৪, ১/১৫৫ পৃঃ, (ইফাবা হা/১০৮৭, ২/৩১২ পৃঃ), ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১২১৩, ‘রাত্রিতে উঠে কি বলবে’ অনুচ্ছেদ।
[6]. মুসলিম হা/১৮৪৭, ১/২৬৩ পৃঃ, ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; মিশকাত হা/১২১২; আবুদাঊদ হা/৭৭৫; মিশকাত হা/১২১৭।
[7]. মুসলিম হা/১৮৪২-৪৩, ১/২৬২ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬৭৫-১৬৭৬), ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; মিশকাত হা/১১৯৩-৯৪, ৯৭, ‘রাতের স্বলাত’ অনুচ্ছেদ।
[8]. বুখারী হা/১১৪৭, ২০১৩, ১/২৬৯ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭৫৭।
[9]. মুসলিম হা/১৭৫১ ও ১৭৫২, ১/২৫৩ পৃঃ, ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭।
[10]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; সহিহ বুখারী হা/৯৯০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৫, (ইফাবা হা/৯৩৭, ২/২২৫ পৃঃ), ‘বিতর স্বলাত’ অধ্যায়-২০, অনুচ্ছেদ-১; সহিহ মুসলিম হা/১৭৮২, ১৭৮৪, ১৭৮৫, ১৭৮৬, ১/২৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬১৮-১৬২১); মিশকাত হা/১২৫৪, পৃঃ ১১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৫, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৩০ এবং বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৮, ৩/১৩১ পৃঃ।
[11]. আবুদাঊদ হা/১৩৬২, ১/১৯৩ পৃঃ; মিশকাত হা/১২৬৪, পৃঃ ১১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৯৫, ৩/১৩৫ পৃঃ, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ; উল্লেখ্য যে, ‘১১ রাক‘আতের বেশী পড়’ মর্মে হাকেমে যে অংশটুকু এসেছে তার সনদ যঈফ ও মুনকার।- হাকেম হা/১১৩৭; ক্বিয়ামে রামাযান পৃঃ ১৭; স্বলাতুত তারাবীহ, পৃঃ ৯৯ ও ১১২।
[12]. আবুদাঊদ হা/১৪৩৯, ১/২০৩ পৃঃ; নাসাঈ হা/১৬৭৯, সনদ সহিহ।
[13]. আবুদাঊদ হা/১৪৩১, ১/২০৩ পৃঃ; সনদ সহিহ, ইওয়াউল গালীল হা/৪৪২; মিশকাত হা/১২৭৯ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ।
[14]. দারেমী হা/১৬৪৭; সিলসিলা সহিহাহ হা/১৯৯৩; মিশকাত হা/১২৮৬, পৃঃ ১১৩ সনদ সহিহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২১৩, ৩/১৪১ পৃঃ।
[15]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী হা/১১৫২, ১/১৫৪ পৃঃ, ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৭৯০; মিশকাত হা/১২৩৪, পৃঃ ১০৯, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ।
[16]. মুসলিম হা/১৭৭৩, ১৭৭৭, ১/২৫৬ পৃঃ, ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত হা/১২৫৭, পৃঃ ১১১, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ। রাসূল (ﷺ) উক্ত স্বলাত ১২ রাক‘আত পড়েছেন (তন্মধ্যে তাহাজ্জুদের ৮ রাক‘আত ও স্বলাতুয যোহা ৪ রাক‘আত)। -মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/২৬৬।
[17]. আবুদাঊদ হা/২২৬; তিরমিযী হা/৪৪৯; মিশকাত হা/১২০২-০৩, ‘রাত্রির স্বলাত’ অনুচ্ছেদ।

রাতের স্বলাতের ফযীলত :

রাসূল (ﷺ) বলেন, أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ‘ফরয স্বলাতের পরে সর্বোত্তম স্বলাত হল রাতের স্বলাত’।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ فَيَقُوْلُ مَن يَّدْعُوْنِىْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ مَنْ يَّسْأَلُنِىْ فَأُعْطِيَهُ مَن يَّسْتَغْفِرُنِىْ فَأَغْفِرَ لَهُ.

‘আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ তৃতীয় প্রহরে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছ যে আমার কাছে চাইবে আর আমি তাকে দান করব? কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এভাবে আল্লাহ ফজর পর্যন্ত আহবান করতে থাকেন’।[2] যদি কেউ তাহাজ্জুদের নিয়তে শুয়ে যায় এবং পরে ঘুম থেকে জাগতে না পারে, তাহলে সে পূর্ণ নেকী পাবে এবং উক্ত ঘুম তার জন্য ছাদাক্বা হবে।[3]

[1]. মুসলিম হা/২৮১২; মিশকাত হা/২০৩৯, ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী হা/১১৪৫, ১/১৫৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/১০৭৯, ২/৩০৮ পৃঃ), ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; মুসলিম হা/১৮০৮ ও ১৮০৯, ‘মুসাফিরের স্বলাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪; মিশকাত হা/১২২৩, পৃঃ ১০৯, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ।
[3]. নাসাঈ হা/১৭৮৪ ও ১৭৮৭; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৪, ৯৫; সনদ সহিহ, ইরওয়া হা/৪৫৪।

Share: