যে ব্যক্তি ভুলভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে তার পেছনে কি সালাত হবে

উত্তর: যে ইমাম অথবা মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পড়তে গিয়ে এমন ভুল করে যা অর্থ বদলে দেয় তার সালাত বাতিল। কারণ ফাতিহা সালাতের অন্যতম রুকন (স্তম্ভ)।এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:لَا صَلَاةَ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ “যে ব্যক্তি সালাতে সূরা আল-ফাতিহা পড়ল না তার সালাত হলো না।(সহীহ বুখারী হা/৭৫৬) সুতরাং তাকে অবশ্যই পড়া বিশুদ্ধ করতে হবে এবং সঠিকভাবে ফাতিহা পড়া শিখতে হবে। যদি সে চেষ্টা করার পরও তা শিখতে না পারে তাহলে আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কিছু চাপিয়ে দেন না। কিন্তু সে যদি ইমাম হয় তাহলে তার পেছনে কেবল ঐ ব্যক্তিই সালাত পড়বে যে ফাতিহা পড়ার ক্ষেত্রে তার মতো বা তার চেয়ে নিচের স্তরের।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭০২৭০)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:

وتكره إمامة من يلحن في القراءة ؛ ثم ينظر : إن كان لحنا لا يغير المعنى ، كرفع الهاء من الحمد لله ، صحت صلاته وصلاة من اقتدى به ، وإن كان يغير ، كضم تاء أنعمت عليهم أو كسرها ، تبطله ، كقوله الصراط المستقين ؛ فإن كان يطاوعه لسانه ويمكنه التعلم لزمه ذلك ، فإن قصر وضاق الوقت صلى وقضى ، ولا يجوز الاقتداء به .

وإن لم يطاوعه لسانه ، أو لم يمض ما يمكن التعلم فيه ، فإن كان في الفاتحة فصلاة مثله خلفه صحيحة ، وصلاة صحيح اللسان خلفه صلاة قارئ خلف أمي [ يعني أنها لا تصح ] ، وإن كان في غير الفاتحة صحت صلاته وصلاة من خلفه ”

“যে ব্যক্তি ভুলভাবে তেলাওয়াত করে তার ইমামতি করা মাকরূহ। তারপর দেখতে হবে, যদি তার ভুলের কারণে অর্থ বদলে না যায়, যেমন: আলহামদুলিল্লাহি পড়ার সময় হা বর্ণে পেশ দিয়ে আলহামদুলিল্লাহু পড়া, তাহলে তার সালাত ঠিক হবে এবং তার পেছনে থাকা মুসল্লীদের সালাতও হয়ে যাবে। আর যদি অর্থ বদলে যায়, যেমন: আন’আমতা পড়ার সময় তা বর্ণে পেশ দিয়ে আন‌’আমতু অথবা যের দিয়ে আন‌’আমতি পড়ে, তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। একই বিধান যদি ‘সীরাতাল মুস্তাকীন’ পড়ে। যদি তার জিহ্বা সঠিকটা শিখতে সক্ষম হয় তাহলে তার জন্য শেখা আবশ্যক। আর যদি ওয়াক্ত সংকুচিত হয়ে আসে তাহলে সে সালাত পড়ে নিবে এবং পরে কাযা করবে। এমন ব্যক্তির পেছনে সালাত হবে না।

আর যদি তার জিহ্বা সঠিকটা বলতে না পারে কিংবা শেখার মত সময় অতিবাহিত না হয়, তাহলে ভুলটা সূরা ফাতিহায় হলে তার স্তরের ব্যক্তির সালাত তার পেছনে সঠিক হবে। পক্ষান্তরে সঠিক উচ্চারণকারীর সালাত তার পিছনে, ক্বারীর সালাত তার পিছনে (সহিহ হবে না)। আর যদি ভুল পড়া ফাতিহা ছাড়া অন্য স্থানে হয়, তাহলে তার সালাত এবং তার পেছনে থাকা ব্যক্তিদের সালাত সঠিক হবে।(রাওদ্বাতুত তালিবীন: খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৫০)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:

( وإن ) ( أم أمي أميا وقارئا ) ( أعاد القارئ وحده ) . الأمي من لا يحسن الفاتحة أو بعضها , أو يخل بحرف منها , وإن كان يحسن غيرها , فلا يجوز لمن يحسنها أن يأتم به , ويصح لمثله أن يأتم به .. ”

ثم قال : ” ومن ترك حرفا من حروف الفاتحة ; لعجزه عنه , أو أبدله بغيره , كالألثغ الذي يجعل الراء غينا , والأرت الذي يدغم حرفا في حرف , أو يلحن لحنا يحيل المعنى , كالذي يكسر الكاف من إياك , أو يضم التاء من أنعمت , ولا يقدر على إصلاحه , فهو كالأمي , لا يصح أن يأتم به قارئ . ويجوز لكل واحد منهم أن يؤم مثله ; لأنهما أميان , فجاز لأحدهما الائتمام بالآخر , كاللذين لا يحسنان شيئا . وإن كان يقدر على إصلاح شيء من ذلك فلم يفعل , لم تصح صلاته , ولا صلاة من يأتم به . ”

وقال أيضا : ” تكره إمامة اللحان , الذي لا يحيل المعنى , نص عليه أحمد . وتصح صلاته بمن لا يلحن ; لأنه أتى بفرض القراءة , فإن أحال المعنى في غير الفاتحة , لم يمنع صحة الصلاة , ولا الائتمام به , إلا أن يتعمده , فتبطل صلاتهما …

وأما إن كان لا يغيِّر بخطئه معنى الآيات : فيجوز الصلاة وراءه مع وجوب تعلمه للقراءة ، وأما إن كان خطؤه في غير الفاتحة : فهو منقص من الصلاة وليس مبطلا لها ، والصلاة خلف المتقن للقراءة أولى منه ولا شك ، ولا يجوز لولاة الأمر تولية مثل هؤلاء الجهلة الصلاة بالناس ، وإلا كانوا شركاء معهم بالإثم

“যদি কোন উম্মী ব্যক্তি অন্য উম্মী ব্যক্তি ও ক্বারীর ইমামতি করে তাহলে যিনি ক্বারী তিনি তার সালাত পুনরায় পড়বেন। উম্মী হলেন এমন ব্যক্তি যিনি সমগ্র ফাতিহা বা এর কিছু অংশ ঠিকভাবে পড়তে পারেন না অথবা কোনো হরফ বাদ দিয়ে পড়েন, যদিও অন্য সূরা ঠিকভাবে পড়তে পারেন। সুতরাং যিনি সূরা ফাতিহা সঠিকভাবে পড়তে পারেন তার জন্য এই ব্যক্তির পেছনে সালাত পড়া জায়েয নেই। তবে যিনি তার মতই ভুল পড়েন, তিনি তার পেছনে সালাত পড়লে সালাত হবে।…’

তারপর তিনি বলেন: ‘কেউ যদি পড়তে অক্ষম হওয়ার কারণে সূরা ফাতিহার কোনো হরফ ছেড়ে দেয় অথবা একটি হরফের বদলে অন্য হরফ পড়ে, যেমন: যে ব্যক্তি ‘রা’ হরফকে ‘গাইন’ হরফ হিসেবে পড়ে, কিংবা যে ব্যক্তি এক হরফকে অন্য হরফে ইদগাম করে ফেলে কিংবা এমন ভুল করে যা অর্থ বদলে দেয়, যেমন: যে ব্যক্তি ইয়্যাকা পড়ার বদলে ইয়্যাকি পড়ে অথবা আনআমতা পড়ার পরিবর্তে আন’আমতু পড়ে এবং এই ভুল শুধরাতে না পারে, সে নিরক্ষর ব্যক্তির মতই। পড়তে সক্ষম কোনো ব্যক্তির জন্য তার ইক্তিদা করা সঠিক নয়। তবে এই ধরনের ভুল যারা করেন তাদের একজনের জন্য অন্যের পেছনে সালাত পড়া জায়েয। কারণ তারা দুজনই উম্মী। তাই তাদের একজনের জন্য অন্যের পেছনে সালাত পড়া জায়েয। তাদের উদাহরণ ঐ দুই ব্যক্তির মত যারা কিছুই পারে না। আর যদি কিছুটা সংশোধন করার সক্ষমতা থাকে; কিন্তু না করে, তাহলে তার সালাত সঠিক হবে না এবং তার পেছনে যে সালাত পড়ে তার সালাতও সঠিক হবে না।’

তিনি আরো বলেন: “যে ইমাম এমন ভুল করে যে ভুলে অর্থ বদলে যায় না, তার ইমামতি করা মাকরূহ। ইমাম আহমদ এ ব্যাপারে স্পষ্ট বলেছেন। তবে যে ব্যক্তি ভুল করে না, তার পেছনে তার সালাত আদায় সঠিক। কারণ সে পড়ার ফরযটুকু আদায় করেছে। যদি সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে এমন ভুল করে যা অর্থ বদলে ফেলে, তবুও এটি তার সালাতের বিশুদ্ধতা বাতিল করবে না এবং তার পেছনে সালাত পড়াও বাতিল হবে না। কিন্তু যদি সে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করে, তাহলে উভয়ের সালাতই বাতিল হবে।…

আর যদি তার ভুলের কারণে সে আয়াতগুলোর অর্থ বদলে না যায় তাহলে তার পেছনে সালাত আদায় করা সহিহ। তবে পড়া শেখা তার ওপর ওয়াজিব। আর যদি তার ভুল ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছুতে হয়, তাহলে সেটি তার সালাতে ঘাটতি সৃষ্টি করবে, তবে সালাত বাতিল করে দিবে না। নিঃসন্দেহে তার চেয়ে দক্ষ ক্বারীর পেছনে সালাত পড়া অগ্রাধিকার পাবে। এই সমস্ত অজ্ঞদেরকে জনগণের ইমামতির দায়িত্বে নিযুক্ত করা শাসকদের জন্য জায়েয নেই। নতুবা তারাও এই সমস্ত ইমামের সাথে পাপের ভাগীদার হবে।”(দেখুন: আল-মুগনী খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৯-৩২), হাজর ছাপা)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:

… أما إذا كان يخطئ : فإن كان خطؤه لحناً لا يغيِّر المعنى : فالصلاة وراء من لا يلحن أولى إذا تيسر ، وإن كان لحنه في الفاتحة يغيِّر المعنى : فالصلاة وراءه باطلة ، وذلك من أجل لحنه لا لعماه ؛ كقراءة ( إيَّاكَ نَعْبُدُ ) بكسر الكاف ، أو ( أَنْعَمْتَ عَلَيْهِم ) بضم التاء أو كسرها ، وإن كان يخطئ لضعف حفظه : كان غيره ممن هو أحفظ أولى بالإمامة منه .

“…যদি সে ভুল করে এবং তার ভুল এমন হয় যে অর্থ বদলে দেয় না, তাহলে সম্ভব হলে যে ব্যক্তি ভুল করে না, তার পেছনে সালাত পড়া অগ্রাধিকার পাবে। আর যদি সূরা ফাতিহায় সে এমন ভুল করে যা অর্থ বদলে দেয়, তাহলে তার পেছনে সালাত পড়া বাতিল। এর কারণ তার ভুল; তার অন্ধত্ব নয়। যেমন: ইয়্যাকা না’বুদু পড়ার বদলে কা হরফে যের দিয়ে ইয়্যাকি না’বুদু পড়া অথবা আন’আমতা আলাইহিম পড়ার বদলে তা হরফে পেশ অথবা যের দিয়ে আন’আমতু অথবা আন’আমতি পড়া। আর যদি সে মুখস্থের দুর্বলতার কারণে ভুল করে, তাহলে তার তুলনায় মুখস্থে যে শক্তিশালী সে ইমামতির অধিক উপযুক্ত।”(ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ লিল-বুহূসিল ইলমিয়্যা ওয়াল-ইফতা খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫২৭)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: একজন ইমাম কুরআন পড়তে গিয়ে ভুল করেন। কুরআনের আয়াতের হরফগুলো কখনো তিনি বাড়িয়ে অথবা কমিয়ে পড়েন। তার পেছনে সালাতের হুকুম কী?

তিনি উত্তর দেন:

إذا كان لحنه لا يحيل المعنى : فلا حرج في الصلاة خلفه مثل نصب ( رَبِّ ) أو رفعها في ( الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ) الفاتحة/2 ، وهكذا نصب ( الرَّحمنِ ) أو رفعه ، ونحو ذلك ، أما إذا كان يحيل المعنى : فلا يصلى خلفه إذا لم ينتفع بالتعليم والفتح عليه ، مثل أن يقرأ ( إِيَّاكَ نَعْبُدُ ) بكسر الكاف ، ومثل أن يقرأ ( أَنْعَمْتَ ) بكسر التاء أو ضمها ، فإن قبِل التعليم وأصلح قراءته بالفتح عليه : صحت صلاته وقراءته ، والمشروع في جميع الأحوال للمسلم أن يعلم أخاه في الصلاة وخارجها ؛ لأن المسلم أخو المسلم يرشده إذا غلط ويعلمه إذا جهل ويفتح عليه إذا ارتج عليه القرآن .

“যদি তার ভুল পড়ায় অর্থ বদলে না যায়, তাহলে তার পেছনে সালাত পড়াতে সমস্যা নেই। যেমন: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন [সূরা ফাতিহা: ২] পড়ার বদলে রাব্বাল অথবা রাব্বুল পড়া। অনুরূপভাবে আর-রাহমানির পড়ার বদলে আর-রহমানুর কিংবা অনুরূপ ভুল করা। আর যদি অর্থ পাল্টে দেয়, তাহলে তার পেছনে সালাত পড়া যাবে না, যদি তার ভুল শুধরে দেওয়া হলে সে উপকৃত হয়ে শুধরে না নেয়। যেমন: যদি সে ইয়্যাকা পড়ার বদলে কাফ হরফে যের দিয়ে ইয়্যাকি না’বুদু পড়ে। অনুরূপভাবে সে যদি আন’আমতা পড়ার বদলে তা হরফে যের অথবা পেশ দিয়ে আন’আমতি অথবা আন’আমতু পড়ে। যদি তাকে ঠিক করে দেওয়া হলে সে নিজেকে শুধরে নেয় তাহলে তার সালাত ও কিরাত বিশুদ্ধ হবে। একজন মুসলিমের জন্য সর্বাবস্থায় তার ভাইকে শিখিয়ে দেওয়া উচিত, সেটি সালাতের ভেতরে এবং বাইরে। কারণ এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে ভুল করলে তাকে শুধরে দিবে, সে না জানলে তাকে জানিয়ে দিবে এবং কুরআন পড়তে গিয়ে সে আটকে গেলে তাকে ঠিক করে দিবে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/১২ পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯; আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭০২৭০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: