একটা বক্স হাতে FBS এর দিকে আরজুকে যেতে দেখলাম। ডাক দেবার পর থামলে জিজ্ঞেস করি, কই যাচ্ছিস?
আরজু বললো, ক্যান্সার আক্রান্ত এক মায়ের জন্য টাকা তুলতে যাচ্ছে সে।
এরকম জনহিতকর কাজে সবসময়ই এগিয়ে আসে আরজু, তবে কাউকে বলেনা, এমনকি আমাকেও যেতে বলেনা। ভাবলাম এমনিতেই তো ফ্রি আছি, তাই আরজুর সাথে গেলাম এক ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের জন্য টাকা তুলতে।
সবার কাছে গিয়ে ঐ অসুস্থ মায়ের দূর্দশার কথা বলতে থাকলাম।যে যেরকম পারছে দানবক্সে টাকা দিচ্ছে, কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা, আবার একটু আগে একজন ১০০০ টাকারও একটা নোট দিলেন।
ডাকসুর সামনে যেতে বিপ্লব ভাইকে দেখলাম।সিগারেটের ধূয়া আকাশের দিকে ছেড়ে ঐ ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।
বিপ্লব ভাইয়ের কাছে গিয়ে একটু কথাবার্তা বলে ক্যান্সার আক্রান্ত ঐ মায়ের জন্য টাকা চাইলাম।
বিপ্লব ভাই হেসে বললেন, “এই ১০ লক্ষ টাকা তুলে আর কী করবা তার চেয়ে বরং ঐ মা’কে সামান্য কালোজিরা খাওয়াও।ঠিক হয়ে যাবেন।”
এরকম মুহূর্তে বিপ্লব ভাইয়ের মজা নেওয়া দেখে আমার কিছুটা বিরক্ত লাগলো, বেচারা সিচুয়েশনও বুঝেননা।বিরক্তির সুরে বললাম, “ভাই এগুলো কি বলছেন,ক্যান্সার হইছে এর মধ্যে কালোজিরা খাইয়ে কি হবে?
বিপ্লব ভাই হাসলেন, হাসি থামিয়ে বললেন, “তোমাদের নবী নাকি বলছেন কালোজিরা সকল রোগের ওষুধ (!) তাহলে আবার টাকা তুলে ক্যান্সার রোগীদের সাহায্য করার দরকার কি?কালোজিরা খাওয়ালেই তো হয়।”
বিপ্লব ভাই যেটা বলছেন, সেটাতো আসলেই সত্যি। ছোটবেলায় এরকম ওয়াজ শুনেছিলাম যে, কালোজিরা খাইলে সব রোগ কমে যায়, তাহলে ক্যান্সার রোগীকে কালোজিরা খাওয়ানো হয়না কেন? নাকি এই হাদীসটি অযৌক্তিক!
আরজু বিপ্লব ভাইকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ভাই,আপনি কি এই হাদীসটা কোনো হাদীস গ্রন্থ থেকে পড়েছেন, কিংবা কোনো হাদীসের এপস থেকে পড়েছেন?”
বিপ্লব ভাই অনেকটা রেগে গিয়ে বললেন, “তার মানে,আমি কি মিথ্যা বলছি? এটা সহীহ বুখারীর হাদীস।”
আরজু বললো, “ভাই আমি ঐটা বলিনি, হাদীসটা সহীহ না জাল।আমি জিজ্ঞেস করছি এই হাদীসটা আপনি কোথায় থেকে জানছেন? মুক্তমনা ব্লগ থেকে নাকি হাদীসের বই থেকে?”
বিপ্লব ভাইয়ের কন্ঠ এখন একটু নরম হলো, তিনি বললেন, “আমি ব্লগ থেকে জানছি।”
আরজু হাসলো, “আমি জানতাম এরকমই হবে।আপনারা হাদীস শিখেন মুক্তমনা ব্লগে ঢুকে, হাদীসের এতগুলো বই বাদ দিয়ে যেখানে ইসলামের বিদ্বেষী লেখালেখি হয় সেখানে যান। হাদীস শিখতে।”
আরজুর কথাশুনে বিপ্লব ভাই সত্যি সত্যি রেগে গেলেন, আরজুকে শাসিয়ে বললেন, “হইছে হইছে এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।ক্যান্সার রোগীকে তোমাদের নবীর কথামতো কালোজিরা খাওয়াও না কেন?”
আরজু বললো, “আপনার বলা মিথ্যা হাদীসটির সংশোধন আগে করে নেই। নবী সা: বলেছেন, কালোজিরা সাম ব্যতীত সকল রোগের উপশম (healing)। সাম মানে হলো মৃত্যু। (বুখারী: ৫৬৮৮, তিরমিযী ২০৪১, ইবনু মাজাহ ৩৪৪৭)।
ভালো করে দেখুন এখানে ওষুধ বলা হয়নি, বলা হয়েছে উপশম/healing। এখন বলুন উপশম আর ওষুধ কি এক হয়?”
নিজের ভূয়া তথ্যের জালে নিজেই আটকে গিয়ে বিপ্লব ভাইয়ের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছেনা।
আরজু বলে চললো, “তবে কালোজিরাতে এমন সব উপাদান আছে যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পথপ্রদর্শক ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন ফিত তিবব’ (Canon Of Medicine) গ্রন্থে বলেছেন, কালোজিরা দেহের প্রাণশক্তি বাড়ায় এবং এর মধ্যে শতাধিক পুষ্টি উপাদান রয়েছে যার মধ্যে ২১ শতাংশ প্রোটিন, ৩৮ শতাংশ শর্করা, স্নেহ পদার্থ ৩৫ শতাংশ এবং বাকি অংশ ভিটামিন ও খনিজ।”
বিপ্লব ভাই বললেন, এগুলো তো তোমদের নবীর হাদীস ডিফেন্স করতে গিয়ে মুসলিম বিজ্ঞানীর কথা।তিনি তো কালোজিরার পক্ষেই সাফাই গাইবেন।
আরজু হাসলো, “আপনাদের নিয়ে পারিও না! আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার জোসেফ মেরকোলার (Joseph Mercola) নাম শুনছেন?”
বিপ্লব ভাই না সূচক মাথা নাড়লেন।
আরজু বলে চললো, উনি হলেন আমেরিকার একজন বিখ্যাত ডাক্তার। Fat for fuel:A Revolution, The No-Grain Diet এরকম কয়টি বিখ্যাত বইও লিখেন।
কালোজিরা নিয়ে ৬৫০ টা রিসার্চ করা হয় উনার অধীনে। এই রিসার্চ এর সমাপ্তীতে তিনি বলেন,কালোজিরার মধ্যে ফার্মাকোলজিকাল কমপক্ষে ২০ টা উপাদান আছে।
তারমধ্যে থাইমোকুইনইন (Thymoquinone) হলো এন্টি-ক্যান্সারের জন্য ব্যবহৃত উপাদান।
কালোজিরার মধ্যে এই থাইমোকুইনইন উপাদানটি পাওয়া যায়।
অক্সিডিটিভ স্ট্রিস (Oxidative Stress) ডায়াবেটিস নিরোময়ে ব্যবহৃত হয়।
কালোজিরার মধ্যে এই উপাদানটি ও পাওয়া যায়।
বিপ্লব ভাইয়ের হাতের সিগারেটের শেষ টান দিলেন।
আরজু বললো, “নবী সা: বলেননি রোগ হলে কালোজিরা খেতে, তিনি বলেছেন কালোজিরা খেতে যাতে সেটি রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে আরো শক্তিশালী করে। কিন্ত হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আপনি বলছেন ওষুধের কথা!”
সিগারেট ফেলে দিয়ে বিপ্লব ভাই পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে দানবক্সে রাখলেন।
আমি বললাম, বিপ্লব ভাই! সিগারেটের পকেটে কিন্ত লেখা আছে, ‘Smoking causes Cancer’
তাই ধূমপানও করুন, কালোজিরাও খান।
আমার কৌতুক শুনে বিপ্লব ভাই হাসলেন।
আমরা চললাম পরবর্তী জনের কাছে,
“ভাই, আমাদের বন্ধুর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত, একটু যদি সাহায্য করতেন…”
লেখক ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থী
বিয়ে করার সেরা সময় কখন?
বাংলা সাহিত্যে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের (১৮২৫-১৮৯৪) পারিবারিক প্রবন্ধসমূহ যথেষ্ট খ্যাত হয়ে আছে। তার লেখা এসব প্রবন্ধের মধ্যে একটি হলো, বাল্যবিয়ে নিয়ে। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম বাল্যবিয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভূদেব বাল্যবিয়ের সমর্থক ছিলেন। তিনি তার প্রবন্ধে বলেছেন- ‘মেয়েরা বিবাহের পর শ্বশুর বাড়িতে চলে যায়। শ্বশুর বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে সে সুখী হতে পারে না। মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গেলে সেই বাড়িরই একজন হয়ে বেড়ে ওঠে। তাই তাদের পক্ষে সহজ হয় শ্বশুরবাড়ির জীবনধারার সাথে একইভূত হতে পারা। কিন্তু বেশি বয়সের মেয়েদের পক্ষে এটা সম্ভব হতে পারে না। তারা শ্বশুরবাড়িতে জড়িয়ে পড়তে চায় বিবাদবিসম্বাদে।’
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সময়ের হিন্দু পরিবার সাধারণত হতো যৌথ পরিবার। মেয়েদের হতে হতো তাদের শ্বশুর বাড়িতে সেই যৌথ পরিবারেরই একজন। ভূদেব এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছিলেন বাল্যবিয়েকে। হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়, অষ্টমবর্ষে গৌরী দান। হিন্দুধর্মে বাল্যবিয়েকে সমর্থন করা হয়। ভূদেবের ওপর পড়েছিল হিন্দুশাস্ত্রেরও প্রভাব। তাদের শাস্ত্রে বাল্যবিয়ে সমর্থন করা হয়েছে প্রধানত দু’টি কারণে। একটি কারণ হলো, বাল্যবিয়ে হলে মেয়েরা খুব অল্প বয়সেই পেতে পারে স্বামীর সুরক্ষা। অন্য দিকে, অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা যৌন কামনার বশে বিপথগামী হয় না। কেননা, স্বামী তাদের যৌনতৃষ্ণা মেটাতে পারে। স্ত্রীরা সহজেই থাকতে পারে সতীসাধী। বজায় থাকতে পারে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই যুক্তি দু’টি রবীন্দ্রনাথও মানতেন, যদিও তিনি ছিলেন না খাঁটি হিন্দু।
তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম। কিন্তু ব্রাহ্ম-সমাজের যে শাখার তিনি ছিলেন প্রতিনিধি, সেই আদি ব্রাহ্ম সমাজের অনেক রীতি নীতিই ছিল হিন্দুশাস্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ তার কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন, যতদূর জানি, মাত্র ৯ বছর বয়সে। একসময় বিলাতেও খুব কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হতো। শেকসপিয়রের বিখ্যাত নাটক রোমিও জুলিয়েটে আমরা দেখি, নায়িকা জুলিয়েটের বয়স যখন চৌদ্দ, তখনই সে রোমিওর প্রেমে হতে পেরেছে প্রমত্তা। একসময় বিশ্বের সর্বত্রই মনে করা হতো মেয়েরা ঋতুমতী হলে সে হয় বিয়ের উপযুক্ত। সেটাই তার বিয়ের বয়স।
ইসলাম ধর্মে বিয়েতে মেয়েদের অনুমোদন লাগে। মেয়েরা স্বামীকে কবুল না করলে ইসলামি মতে বিয়ে হতে পারে না। কিন্তু বাংলার মুসলমান সমাজে বাস্তব ক্ষেত্রে এই রীতি ঠিক প্রচলিত ছিল বলে মনে হয় না। অভিভাবকেরাই তাদের মেয়ের বিয়ে ঠিক করতেন। আর তাদের কন্যারা পারিবারিকভাবে স্থিরীকৃত ব্যক্তিকেই মেনে নিত তাদের স্বামী হিসেবে। শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয় অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয়, তখন আমার বয়স বারো তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম, আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর, তখন তার মা মারা যান।
একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মার কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আরেক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাতের ব্যবধান (অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পৃষ্ঠা ৭-৮, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা ২০১২)। শেখ মুজিব তার বিয়ের যে বর্ণনা দিয়েছেন সেটা ছিল তার সময়ের মুসলমান সমাজের প্রায় সাধারণ ধারা। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হতো। কেননা, তাতে বাড়ত পারিবারিক বন্ধন। হিন্দু সমাজ ও মুসলমান সমাজে বাল্য-বিবাহ থাকলেও দু’টি সমাজের পরিবার প্রথা ঠিক এক ছিল না। যেমন হিন্দু সমাজে বিধবার বিয়ে ছিল অসিদ্ধ। কিন্তু মুসলমান সমাজে তা ছিল না। মুসলমানদের সমাজে বিধবা নারীরা ইচ্ছা করলেই আবার বিয়ে করতে পারতেন।
এ ছাড়া মুসলিম নারীরা পেতে পারতেন তাদের মাতা-পিতার সম্পত্তির অংশ। পেতে পারতেন মৃত স্বামীর সম্পত্তির ভাগও। তাই স্বামীর মৃত্যু হলেই তাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না। এখনো তারা শরিয়তের বিধান অনুসারে পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তির অংশ পাওয়ার অধিকারী। এ ছাড়া তখনো পেতেন এবং এখনো পাচ্ছেন বিয়েতে মোহরানা। হিন্দু সমাজে যেহেতু বিধবা বিয়ে ছিল না, তাই বাল্য-বিধবাদের সমস্যা হয়ে উঠেছিল খুবই প্রবল।
অনেক হিন্দু বিধবা ব্রিটিশ শাসনামলে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং মুসলিম পাত্রকে বিয়ে করেছেন। বাংলায় আদমশুমারি আরম্ভ হয় ১৮৭১ সাল থেকে। ওই সময় বাংলায় হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানের চেয়ে বেশি ছিল। এর পর ১৮৮১ সালে যে আদমশুমারি হয় তাতে দেখা যায়, হিন্দুর সংখ্যা কমতে ও মুসলিম সংখ্যা বাড়তে। এর পর থেকে মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। অনেকে বলেন, এর একটা কারণ হলো- হিন্দু বিধবাদের মুসলমান স্বামী গ্রহণ। তবে এটাই যে প্রধান কারণ, তা বোধহয়, বলা চলে না। কেননা সে সময় দেখা যায়, হিন্দু মায়েদের সন্তান কম হতে আর মুসলমান মায়েদের সন্তান বেশি হতে। অপরদিকে, যেসব হিন্দু মহিলা মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতেন, তাদেরও সন্তান হতো বেশি। কেন এরকম ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা এখনো কেউ দিতে পারেননি। প্রচার করা হয়, বাংলাদেশে ইসলাম জোর করে প্রচার করা হয়েছিল।
কিন্তু ইতিহাস বলে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আর এ সময় গায়ের জোরে ইসলাম প্রচারের কোনো প্রশ্নই ছিল না। অনেক মিথ্যা কথা এখন প্রচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে গায়ের জোরে ইসলাম প্রচারও হলো অন্যতম। একসময় হিন্দু সমাজে অনেক ভয়ঙ্কর প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন স্বামীর চিতায় তার বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা। লর্ড বেন্টিঙ্ক এই ‘সতীদাহ’ প্রথাকে রদ করেন ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে।
বাংলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সতীদাহ হতো অনেক বেশি। মুসলমান সমাজে এরকম কোনো প্রথা ছিল অকল্পনীয়। কেননা, মুসলাম নারী-পুরুষকে মৃত্যুর পর কবর দেয় হতো, পোড়ানো হতো না। কিন্তু এখন প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে, মুসলমান নারীরা ছিলেন হিন্দু নারীর তুলনায় অনেক বেশি নির্যাতিতা। যেটাও ইতিহাসের নিরিখে সত্য নয়। বাইবেলে বলা হয়েছে ডাইনি মেয়েকে পুড়িয়ে মারার কথা। ইংল্যান্ডে একসময় অনেকে মেয়েকে ‘ডাইনি’ বলে কথিত বিচার করে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে কোনো মেয়েকে পুড়িয়ে মারার আইন উঠিয়ে দেয়া হয় ১৯৩৬ সালে।
কিন্তু আল কুরআনে মেয়েরা কখনো ডাইনি হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি বলা হয়নি, হজরত আদম বেহেশত থেকে দুনিয়াতে পতিত হয়েছিলেন হাওয়া বিবির ‘গম খাবার উপদেশ’ শুনে। ইসলামে নারীকে ‘পাপের উৎস’ বলে বর্ণনা করা হয়নি। যেমন করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, মেয়েদের সম্মানসহকারে বিয়ে করতে হবে এবং পালন করতে হবে সংসার-ধর্ম (সূরা, ৪:১৯)। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত হাদিস হলো, আল্লাহ সবচেয়ে খুশি হন ক্রীতদাসকে মুক্তি দিলে।
আর সবচেয়ে বেশি দুঃখ পান স্ত্রীকে তালাক দিলে যদিও সেই তালাক হয় আইনসম্মত। তবে ইসলামে বলা হয়নি মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কে। রজঃবতী নারীকেই ধরে নেয়া হয়েছে বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে। ছেলেদের বেলায়ও কোনো ন্যূনতম বয়সের কথা বলা হয়নি। ছেলেদের বিয়ের উপযুক্ত ধরা হয়েছে তাদের দেহে বীর্য উৎপাদন শুরু হলেই। অর্থাৎ ইসলামি মতে, নর-নারীর বিয়ে হতে পারে তারা সাবালক প্রজনন শক্তিসম্পন্ন হলেই।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ছেলেদের বিয়ের বয়স করা হয়েছে ২১ বছর আর মেয়েদের ১৮ বছর। কিন্তু ভারতের একটি হাইকোর্ট ২০১২ সালে রায় দিয়েছে, মুসলমান মেয়েরা ১৫ বছর বয়সেই বিবাহযোগ্যা বলে বিবেচিত হতে পারবে। পত্রিকার খবর (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬) পড়ে জানলাম, নিউ ইয়র্ক শহরে হিউম্যান রাইটস নামক সংগঠন পথসভা করে দাবি করেছে, বাংলাদেশে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেয়া চলবে না। কিন্তু খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সব অঙ্গরাজ্যে বিয়ের ন্যূনতম বয়সের আইন এক নয়।
যেমন নিউহ্যাম্পশায়ারে ১৩ বছরের মেয়ে ও ১৪ বছরের ছেলের মধ্যে বিয়ে হতে পারে, যদি মাতা পিতার অনুমোদন থাকে। এর চেয়েও কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ে হতে পারে যদি আদালত অনুমতি দেন। কোনো কম বয়সী মেয়ে যদি গর্ভবতী হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আদালত তার বয়স বিবেচনা না করেও তাকে বিয়ের অনুমতি দিতে পারেন। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে মেয়েদের বয়স ১৬ হলে, মাতা-পিতার অনুমতিতে সে বিয়ে করতে পারে। ১৮ বছর বয়স হলে সে বিয়ে করতে পারে মাতা-পিতার অনুমোদন ছাড়াই। আদালত বিশেষ বিবেচনায় যেকোনো বয়সের মেয়েকেই বিয়ের অনুমতি দিতে পারে।
আসলে টেক্সাসে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স বলে কিছু বেঁধে দেয়া হয়নি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারবাদীরা প্রতিবাদ তুলছেন বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে। সব মুসলমান দেশের বিয়ের বয়স এক নয়। মালয়েশিয়াতে শরিয়াহ আদালত অনুমতি দিলেই যেকোনো বয়সের মুসলমান মেয়েরই বিয়ে হতে পারে। আমাদের দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছেন ‘ভারতপন্থী’। তারা সবকিছুতেই চাচ্ছেন ভারতকে অনুকরণ করতে। কিন্তু ভারতেও এখন দাবি উঠছে ১৮ বছরের পরিবর্তে মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার।
মেয়েদের জীবন আর ছেলেদের জীবন এক নয়। মেয়েদের জীবনে বার্ধক্য আসে অনেক তাড়াতাড়ি। তারা হারায় তাদের প্রজনন ক্ষমতা। বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশসমূহে। মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণের সময় তাদের যৌবনের ওপর জলবায়ুর প্রভাবকেও বিবেচনায় নেয়া উচিত। এটা আমরা নিতে চাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। আমরা বলছি কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। কিন্তু এটা কতদূর সত্য, তা বলা যায় না।
কেননা, নয় দশ বছরের মেয়েরা রজঃমতী হলেও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তারা হয় না প্রজনন-শক্তিসম্পন্না। একে বলা হয় বয়োসন্ধির অনুর্বরতা (Adolescent sterility)। অন্য দিকে, বেশি বয়সের মেয়েরা বিয়ে করলে তাদের সন্তান হাবাগোবা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, বেশি বয়সের মায়েদের জরায়ুর আয়তন যথাযথভাবে বৃদ্ধি পেতে চায় না। ফলে ভ্রুণের মাথার ওপর পড়ে চাপ। এতে মাথার আয়তন হতে চায় ছোট। তাতে মগজের পরিমাণ হয় কম। এসব ছেলে হয় হাবাগোবা। যাকে ইংরেজিতে বলে Mongoloid Imbecility। এ ছাড়া বেশি বয়সের মায়েদের সন্তান প্রতিপালনের কাজে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তারা সুষ্ঠুভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে পারেন না, অল্পতেই হয়ে যান বিরক্ত। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানব শিশু সাধারণভাবে বাঁচে মাতৃস্তন্য পান করে। কিন্তু বেশি বয়সের মেয়েদের দুগ্ধ-ক্ষরণ হতে দেখা যায় কম। এটাও হয়ে ওঠে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যারই কারণ। প্রচার করা হচ্ছে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা হয় গৃহবন্দী।
কিন্তু বাস্তবে নারীরা গৃহবন্দী হন সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে; পুরুষ শাসনের ফলে নয়। গড়পড়তা মেয়েদের পুরুষের চেয়ে কায়িক শক্তি কম। কায়িক শক্তি কম বলে তারা গৃহকর্মে যতটা পারদর্শী, গৃহের বাইরে যেসব কাজে বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়, সেটা তারা করতে পারেন না। এর জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে শ্রম বিভাজন। এটাকে কোনো মতেই ‘পুরুষ শাসনের ফল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে না।
তবুও এ দেশের বাম চিন্তকেরা সেটাই করতে চাচ্ছেন। তাদের এই চিন্তা আমাদের পরিবার ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, মানবশিশু জন্মায় খুবই অসহায়ভাবে। তার হাঁটতে শিখতেই লেগে যায় এক বছরের বেশি সময়। এ কারণে মানবশিশু প্রতিপালনে প্রয়োজন হয় অধিক যত্নের। পরিবার প্রথা গড়ে ওঠার এটাই হলো প্রধান কারণ। রিরংসা জৈবিক, কিন্তু পরিবার প্রথা হলো সাংস্কৃতিক। মানুষ যৌন প্রবৃত্তি জন্মগতভাবেই পায়। কিন্তু পরিবার প্রথা সে লাভ করে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সূত্রে।
এবনে গোলাম সামাদ
লেখক: প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।