গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
মুহররম মাসের ফযীলতঃ
১) প্রখ্যাত সাহাবী আবু বাকরা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলা আসমান সমূহ এবং যমিন সৃষ্টির দিন যে আকৃতিতে সময়কে সৃষ্টি করেছিলেন সেটা আবার তার নিজস্ব কৃতিতে ফিরে এসেছে। বরং এবং বারো মাসে এক বছর। তম্মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক। সেগুলো হল: যুল কা’দাহ (যিলকদ), যুল হিজ্জা (যিলহজ্জ) এবং মুহাররম এবং আরেকটি হল মুযার সমপ্রদায়ের রজব মাস যা জুমাদাল ঊলা এবং শাবানের মধ্যেখানে রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
২) আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: রামাযানের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায।” (মুসলিম)
৩) আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “জাহেলী যুগে কুরায়শগণ আশুরার রোযা পালন করত। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে নিজে আশুরারা রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু‘ যখন রামাযানের রোযা ফরয হল তখন তা পরিত্যাগ করা হল। যার ইচ্ছা রাখত যার ইচ্ছা রাখতনা।” (বুখারী)
৪) ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা আগমণ করার পর দেখলেন, সেখানকার ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা পালন করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা কিসের রোযা রাখ? তারা বলল: এটি একটি কল্যাণময় দিন। এ দিন বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ তাআলা তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই মুসা (আঃ) এ দিন রোযা পালন করেছিলেন। (বিধায় আমরাও মূসা আ. এর অনুসরণে এ দিনটিতে রোযা পালন করি)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমি তোমাদের চেয়ে মুসাকে অনুসরণ করার বেশি হকদার।” অতঃপর তিনি এ দিন রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন।” (বুখারী-মুসলিম)
৫) আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: ইহুদীরা আশুরার দিনকে ঈদ মনে করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃএব তোমরা এ দিন রোযা রাখ।” (বুখারী-মুসলিম)
৬) হুমাইদ বিন আব্দুর রহমান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মুআবিয়া রা. কে হজ্জের বছর আশুরার দিন মিম্বরের উঠে বক্তব্য দিতে শুনেছি। তিনি বলছেন, হে মদীনাবাসী, তোমাদের আলেমগণ কোথায়? আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আজ আশুরার দিন। আল্লাহ এ দিন রোযা রাখা ফরয করেন নি। কিন’ আমি রোযা রেখেছি। অতঃএব, তোমাদের কেউ চাইলে রোযা রাখতে পারে, নাও রাখতে পারে। (বুখারী ও মুসলিম)
৭) ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে এই আশুরার দিনের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে এত গুরুত্বসহকারে অন্য কোন দিন রোযা পালন করতে দেখি নি। (অর্থাৎ রামাযান মাস ছাড়া) (বুখারী)
৮) রুবাই বিন্ত মুআউওয়ায রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিন সকাল বেলা আনসারদের মহল্লায় মহল্লায় এ ঘোষণা দেয়ার জন্য লোক পাঠালেন যে, যে ব্যক্তি রোযা রাখেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ রোযা অস্থায় থাকে আর যে রোযা রেখেছে সে যেন রোযা পূর্ণ করে।”
রুবাই রা. বলেন: আমরা নিজেরা রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরকে রোযা রাখাতাম। আর তাদের জন্য রঙ্গিন পশম দ্বারা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। কেউ কান্নাকাটি করলে সেটা তাকে দিতাম যেন ইফতারের সময় পর্যন্ত রোযা অবস্থায় থাকে।” (বুখারী ও মুসলিম)
৯) সালামা বিন আকওয়া রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ ঘোষণা দেয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি খেয়ে ফেলেছে সে যেন দিনের বাকী অংশ রোযা থাকে আর যে খায়নি সেও যেন রোযা অবস্থায় থাকে। কারণ, আজ আশুরার দিন। (বুখারী-মুসলিম)
১০) আবু কাতাদা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন: প্রতি মাসে তিন দিন এবং এক রামাযান থেকে আরেক রামাযান পর্যন্ত রোযা রাখলে সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব অর্জিত হয়। আরাফার দিন রোযা রাখলে আল্লাহর নিকট আশা করি যে তিনি এর বিনিময়ে আগের ও পরের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দিবেন। আর আশুরার দিন রোযা রাখলে আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে পূর্বের এক বছরের গুনাহ মোচন করবেন। (সহীহ মুসলিম)
১১) আব্দুল্লাহ ইব্ন উমার রা. বর্ণনা করেন, জাহেলী যামানার লোকেরা আশুরার দিন রোযা পালন করত। রামাযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানগণও এ দিন রোযা পালন করতেন। পরবর্তীতে রামাযানের রোযা ফরয হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আশুরার দিন আল্লাহ তাআলার দিন সমূহের মধ্য থেকে একটি দিন। যার ইচ্ছা সে এ দিন রোযা রাখতে পারে আর যার ইচ্ছা রোযা বাদও দিতে পারে। (সহীহ মুসলিম)
১২) জাবির বিন সামুরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আশুরার দিন রোযা রাখতে আদেশ করতেন ,উৎসাহিত করতেন এমনকি রোযা রাখার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন। অতঃপর রামাযানের রোযা ফরয হলে তিনি এ রোযার ব্যাপারে আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না এবং এ ব্যাপারে খোঁজ-খবরও নিতেন না। (সহীহ মুসলিম)
১৩) ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আশুরার দিন রোযা রাখলেন এবং অন্যদেরকে রাখার জন্য আদেশ করলেন তখন সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এ দিনটিকে তো ইহুদীরা সম্মান করে?! তিনি বললেন: ইনশাআল্লাহ আগমী বছর নয় তারিখে রোযা রাখব।” অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আগামীতে বেঁচে থাকলে নয় তারিখে রোযা রাখব।” (সহীহ মুসলিম)
ইব্ন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আশুরার দিন রোযা রাখ এবং এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধীতা করে এর আগের দিন বা পরের দিন রোযা রাখ।” (মুসনাদ আহমাদ, সহীহ ইব্ন খুযায়মা ইত্যাদি)
ইমাম আহমাদ ইব্ন হাম্বল রাহ. বলেন: মাসের শুরু চিনতে অসুবিধা হলে (নয়, দশ ও এগার এ) তিন দিন রোযা রাখবে। যেন নয় ও দশ তারিখে রোযা নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করা যায়। মুগনী (৩/১৭৪)
আশুরার শোক উদ্যাপন বিদ্আত
মুহার্রম মাসের দশ তারিখ আশুরার দিন হিসেবে পরিচিত। ৬১ হিজরীর ১০ মুহার্রাম তারিখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হুসাইন রা. কে শাহাদাতের মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। এই শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা অনেক উন্নীত করেছেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান ও হুসাইন রা. এর ব্যাপারে এ শুভ সংবাদ প্রদান করে গেছেন যে, তারা হবেন জান্নাতের যুবকদের নেতা। আর এ কথা চির সত্য, যে যত বড় মর্যাদা লাভ করে তাকে তত বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হল, মানব জাতির মধ্যে কে সব চেয়ে বেশি পরীক্ষা ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন? তিনি বললেন, নবীগণ, তারপর আল্লাহর নেককার বান্দাগণ। তারপর অন্যদের মধ্যে যারা যে পরিমাণ ঈমান ও পরহেযগীতার অধিকারী তারা সে পরিমান পরীক্ষা সম্মুখীন হয়েছেন। মানুষ তার দীনদারী অনুযায়ী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। কেউ যদি মজবুত দ্বীনের অধিকারী হয় তবে সে বেশি পরিমান পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। আর কারো দ্বীনদারীতে কমতি থাকলে তার বিপদাপদ কম আসে এবং পরীক্ষাও কম হয়। মুমিন বান্দা যতদিন পৃথিবীতে চলা ফেরা করে ততদিন তার উপর বিপদাপদ পতিত হতে থাকে এবং এভাবে তার আর কোন গুনাহ বাকী থাকে না।” (মুসনাদ আহমদ ও তিরমিযী, সনদ হাসান)
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাদের এই মর্যাদা পূর্বেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মতই বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন। ইসলামের মর্যাদা নিয়েই তারা দুনিয়াতে আগমন করেছেন এবং ইসলাম প্রদত্ব মর্যাদা সহকারে তারা প্রতিপালিত হয়েছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সংস্পর্ষ, স্নেহ-মমতা, আদর ও ভালবাসা পেয়ে তাদের জীবন সৌভাগ্য মন্ডিত হয়েছে। যার কারণে মুসলমানগণ তাদের প্রতি অত্যন- শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।
রাসূল যখন ইহজগত ত্যাগ করেন তখন তাঁরা ভাল-মন্দ বুঝার বয়সে উপণিত হননি।
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এমন নিয়ামত দিয়েছেন যার মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে গিয়ে মিলিত হতে পারে। কারণ, তাদের চেয়ে যিনি বেশি মর্যাদার অধিকারী তথা তাদের পিতা আলী (রাঃ) ও শহীদ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন।
হুসাইন রা. এর নিহত হওয়ার ঘটনায় জনমানুষের মাঝে ফেত্না-ফাসাদের বিস্তার ঘটে। যেমন উসমান রা. এর নিহত হওয়ার ঘটনা বিরাট বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে। যার কারণে আজ পর্যন্ত মুসলিম জাতি বিভক্ত।
খারেজী সম্প্রদায়ের আব্দুর রহমান বিন মুলজিম আলী রা. কে হত্যা করার পর সাহাবীদের একাংশ হাসান রা. এর হাতে বাইআত নিলেন। তার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমার এই ছেলে মুসলমানদের দুটি বড় বড় বিবাদমান দলের মধ্যে সমাধান করবেন।” তিনি রাষ্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। এর মাধ্যমে মুয়াবিয়া এবং হাসান রা. এর সমর্থক দু দলের মধ্যে সমাধান হল। অতঃপর তিনি ইহজগত ত্যাগ করলেন। এরপর বেশ কিছু মানুষ হুসাইন রা. এর নিকট চিঠির পর চিঠি লেখা শুরু করল। তারা বলল, যদি হুসাইন রা. ক্ষমতা গ্রহন করেন তবে তাঁকে তারা সাহায্য-সহযোগিতা করবে। অথচ তারা এ কাজের যোগ্য ছিল না।
অতঃপর হুসাইন রা. যখন তাদের নিকট তার চাচাতভাই মুসলিম ইব্ন আকীল ইব্ন আবু তালিবকে পাঠালেন তখন তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তার দুশমনকে তাকে প্রতিহত করতে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করল।
এদিকে বিচক্ষণ সাহাবীগণ এবং হুসাইন রা. হিতাকাংখীগণ যেমন ইব্ন আব্বাস, ইব্ন উমর প্রমুখ তারা সবাই হুসাইন রা. কে ঐ সকল লোকদের ডাকে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন: হুসাইন রা. সেখানে যাওয়াতে কোন লাভ নেই। এতে কোন কল্যাণ বয়ে আসবে না। পরে ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হল।
হুসাইন রা. বিজ্ঞ সাহাবীগণের পরামর্শ উপেক্ষা করে যখন বের হলেন তখন দেখলেন, অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি তাদের নিকট আবেদন করলেন, তাকে ছেড়ে দেয়া হোক তিনি যেন তিনি ফিরে যেতে পারেন অথবা কোন সীমান্ত প্রহরায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন। অথবা তাকে যেন তার চাচাত ভাই ইয়াযীদের সাথে সাক্ষাত করতে দেয়া হয়। কিন্তু তারা তার কোন প্রস্তাব গ্রহন করল না। বরং তাকে চর্তুদিক থেকে ঘিরে ফেলে যুদ্ধ করতে বাধ্য করল। তিনি এবং তার সঙ্গীগণ যুদ্ধ করে পরিশেষে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন।
এই শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে আধিষ্ঠিত করলেন এবং তাঁর অন্যান্য পূত-পবিত্র পরিবার বর্গের সাথে মিলিত করলেন এবং তাঁর উপর যারা এহেন নিষ্ঠুর আচরণ করল তাদেরকে লাঞ্ছিত করলেন।
ইতিহাসের এই জঘণ্য হত্যাকান্ড জনমানুষের মধ্যে অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলল। মানুষ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এ নিয়ে অনেক মানুষ মুনাফেফী, মূর্খতা এবং গোমরাহীর মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। একদল মানুষ এই আশুরার দিন কে মাতম, আহাজারী, কান্নাকাটি এবং শোক দিবস হিসেবে গ্রহণ করল। তারা সেদিন জাহেলী যামানার বিভিন্ন আচরণ প্রদর্শণী শুরু করল। তারা সে দিন, শোক র্যা লী, কাল পতাক মিছিল, নিজের শরীরে চাবুক তলোয়ার ইত্যাদি ধারাল অস্ত্র দ্বারা দিয়ে যখম, নিজেদের গালে আঘাত, শরীরের কাপড় ছেড়া, জামার পকেট ছেড়া, চুল ছেড়া ইত্যাদি বিভিন্ন জাহেলী প্রথা অনুযায়ী শোক দিবস পালন করে থাকে। যা আজ পর্যন্ত পর্যন্ত অব্যহত রয়েছে। প্রতিবছর আশুরার দিন তারা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত এহেন কার্যকলাপ করে থাকে। তারা মনে করে এ সব কাজ করার মাধ্যমে তারা হুসাইন রা. এর আহলে বাইত তথা পরিবার বর্গের প্রতি ভালবাসা এবং সমবেদনা প্রকাশ করে!!
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রাহ. বলেনঃ হুসাইন রা. এর হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে শয়তান মানুষের মধ্যে দুটি বিদআত আবিষ্কার করল। একটি হল, আশুরার দিন শোক ও কান্নাকাটি করার বিদআত। যে দিন শরীরে আঘাত করা, চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, পিপাষার্ত থাকা, মর্ষিয়া পালন ইত্যাদি কার্যক্রম করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় বরং এ দিন পূর্ব পুরুষদেরকে গালাগালী করা হয়, তাদের উপর অভিশাপ দেয়া হয় এবং এমন সব লোকদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় যারা প্রকৃতপক্ষে অপরাধী নয় এবং হুসাইন রা. এর মৃত্যু সংক্রান্ত এমন সব কাহিনী বয়ান করা হয় যেগুলো অধিকাংশই মিথ্যা এবং বানোয়াট।
যারা এসবের সূচনা করেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফেতনা-ফাসাদের দরজা উন্মুক্ত করা এবং মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করা। এসব কাজ তো মুসলামানদের ঐকমত্যে ওয়াজিব নয় মুসতাহাবও নয় বরং এতে শুধু অতীতের বিপদাপদকে কেন্দ্র করে ধৈর্যহীনতা এবং কান্নাকাটি নতুন করে করা হয়। অথচ তা আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল কর্তৃক শক্তভাবে নিষিদ্ধ জিনিস।”
ধৈর্যহীনতা প্রকাশ করা বা চিৎকার-কান্নাকাটি করা ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী। বিপদে-মসিবতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ হল, ধৈর্যের পরিচয় দেয়া, ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্নালিল্লাইহি রাজিঊন পাঠ করার পাশাপাশি আত্মসমালচনা করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: “…আর ধৈর্য ধারণকারীদেরকে শুভ সংবাদ দাও। যারা বিপদ এলে বলে: “ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্নালিল্লাইহি রাজিঊন। এদের উপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই সুপথে প্রতিষ্ঠিত।” (সূরা বাকারা: ১৫৫)
সহীহ বুখারীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: যে ব্যক্তি গালে চপেটাঘাত করে, পকেট ছিড়ে এবং জাহেলীয়াতে মত আহবান করে আমাদের দলভূক্ত নয়।” (মজমু ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম ইব্ন তাইমিয়া ২৫/৩০২, ৩০৭)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে মহিলা (বিপদ-মুসিবতে) চিৎকার করে, মাথা মুন্ডন করে, কাপড় ছিড়ে তার থেকে আমি সম্পর্ক মুক্ত।” (সহীহ মুসলিম)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন: বিলাপকারীনী মাহিলা যদি তাওবা করার আগে মৃত্যু বরণ করে তবে সে কিয়ামতের দিন আলকাতরা মাখানো পায়জামা আর খা বিশিষ্ট বর্ম পরিহিত অবস্থায় উঠবে।” (সহীহ মুসলিম, জানাইয অধ্যায়)
সহীহ বুখারীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: যে মুসলিম বিপদ আপতিত হলে বলে: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইল্লাইহি রাজিঊন, আল্লাহুম্মা আজিরনী ফী মুসীবাতী ওয়াখলুফ লাহু খাইরান মিনহা। অর্থাৎ নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, বিপদে আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর থেকে উত্তম বিকল্প দান কর।” তাকে আল্লাহ তাকে তার বিপদে উত্তম প্রতিদান দিবেন এবং তদাপেক্ষা ভাল বিকল্প ব্যবস্থা করবেন।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জানাইয)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের মধ্যে চারটি জিনিস জাহেলীয়াতের কাজ যেগুলো তারা ছাড়বে না। বংশ আভিজাত্য দিয়ে গর্ব করা, অন্যের বংশকে দোষারোপ করা, তারকার সাহায্যে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং মানুষের মৃত্যুতে বিলাপ করা। (সহীহ মুসলিম, বিতাবুল জানাইয)
সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি হুসাইন রা. এর নিহত হওয়ার ঘটনায় অন্য মুমিনদের প্রতি জুলুম করে, তাদেরকে গালাগালী করে বা তাদের উপর অভিশাপ দেয় এবং দ্বীনের দুশমন ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের কাজে সাহায্য করা সহ অসংখ্য অন্যায় কাজে জড়িত হয় তাদের পরিণতি কী হতে পারে?
শয়তান গোমরাহ লোকদের জন্যে আশুরার দিনকে শোক ও মাতম প্রকাশের দিন হিসেবে সুসজ্জিতভাবে তুলে ধরেছে। যার কারণে এ সব লোক আশুরা আসলে কান্নাকাটি, দুঃখের কাওয়ালী গাওয়া, বানোয়াট কেস্সা-কাহিনী বর্ণনা ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু করে দেয়। এতে কি কিছু লাভ হয়? যা হয় তা হল, মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং গোড়ামীর বিষ বাষ্প ছড়ানো, মুসলামানদের মাঝে ফেতনা-ফাসাদ জাগ্রত করা এবং অতীত মানুষদের গালাগালী করা। এভাবে দ্বীনের মধ্যে অসংখ্য ফেতনা ছড়ানো হয় এবং মিথ্যার পরিচর্চা করা হয়।
ইসলামের ইতিহাসে এত ফেতনা-ফাসাদ, দ্বীনের নামে মিথ্যাচার এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে এ শিয়া সম্প্রদায়দায়টির চেয়ে আগ্রগণ্য আর কোন মানুষ দেখা য়ায় নি।