মুমূর্ষ রোগীকে রক্ত দেওয়া যাবে কি এবং নারীদের জন্য রক্তদানের বিধান

প্রশ্ন: মুমূর্ষ রোগীকে রক্ত দেওয়া যাবে কি? নারীদের জন্য রক্তদানের ক্ষেত্রে পিতা মাতা কিংবা স্বামীর অনুমতি নেওয়া কি বাধ্যতামূলক?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর প্রতি। অতঃপর ইসলামে রক্তদান একটি মহৎ ও মানবিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যদি এটি কোনো মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানোর স্বার্থে জরুরি হয়। রক্তদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এমনকি প্রয়োজনে মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমকে রক্ত দান করতে পারে, আবার অতিব জরুরি প্রয়োজন হলে শারঈ ওজরবসত অমুসলিম থেকেও মুসলিমরা রক্ত নিতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের শিক্ষা প্রদান করে। অমুসলিম মুশরিকগণ আক্বীদাগত তথা বিশ্বাসগত দিক দিয়ে অপবিত্র হলেও মানুষ হিসেবে আদম সন্তান। প্রয়োজনে নারীরাও রক্ত দিতে পারে, তবে শর্ত হচ্ছে রক্তদাতা নারী নিজে পরিপূর্ণ পর্দা বজায় রাখবেন এবং পরিবেশ ফিতনামুক্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ, কোনো পুরুষকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি দাতা বা গ্রহণকারীর মধ্যে ফিতনার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেই নারী রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। ইসলামী শরীয়তে মানবজীবন রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:وَ مَنۡ اَحۡیَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحۡیَا النَّاسَ جَمِیۡعًا ؕ”যে কেউ একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো, সে যেন পুরো মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করলো।”(সূরা মায়েদা ৫:৩২)এই আয়াতটি এমন ব্যক্তির জীবন রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে, যার হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রক্তদান না করলে যেসব রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকেন, তাদের জীবন বাঁচাতে ডাক্তার ও রক্তদাতা উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অপর আয়াতে আরো বলেছেন:”তোমরা ইহসান কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসানকারীদের ভালবাসেন”(সূরা বাক্বারাহ ২/১৯৫)। হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّ لَنَا فِي الْبَهَائِمِ أَجْرً”প্রত্যেক জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনে নেকী রয়েছে”(বুখারী হা/২৩৬৩; মুসলিম হা/২২৪৪; মিশকাত হা/১৯০২)। রাসূল (ﷺ) বলেন,الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তা‘আলা তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার ভাইয়ের কোন কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলাও ক্বিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করবেন’ (বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮)। তিনি বলেন, كُلُّ مَعْرُوف صَدَقَة (নেকীর উদ্দেশ্যে কৃত) প্রত্যেক সৎকর্মই সাদাক্বা (বুখারী,হা/৬০২১ মিশকাত হা/১৮৯৩)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের জন্য সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে অন্যের জন্য উপকারী’ (সিলসিলা সহীহাহ হা/৯০৬)
.
রক্ত দানের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে:

(১). জীবন রক্ষার প্রয়োজনে রক্ত দেওয়া অনুমোদিত যদি কারো জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান করা প্রয়োজন হয় এবং এটি একমাত্র উপায় হয়, তবে এটি ইসলামে এটি জায়েয ও নেকির কাজ। রাসূল ﷺ বলেছেন:كُلُّ مَعْرُوف صَدَقَة (নেকীর উদ্দেশ্যে কৃত) প্রত্যেক সৎকর্মই সাদাক্বা (বুখারী, হা/৬০২১)
.
(২). ইচ্ছাকৃতভাবে ও বিনামূল্যে দান করতে হবে। রক্ত দেওয়ার বিনিময়ে কোন টাকা পয়সা দাবি করা যাবে না। কারন ইসলামে মানব দেহের কোনো অঙ্গ বা রক্ত বাণিজ্যিকভাবে কেনাবেচা করা নিষিদ্ধ। হাদিসে ও রাসূল (ﷺ) রক্তের মূল্য ও কুকুরের মূল্য নিতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারী হা/৫৯৪৫)
.
(৩). নিজের স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যদি রক্তদাতার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে রক্তদান না করাই উত্তম। ইসলামে নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন:لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ”নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই করা যাবে না”।(ইবনু মাজাহ হা/২৩৪১)
.
(৪). নারীরা কাউকে রক্ত দানের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে শারঈ হিজাবের বিধিবিধান অনুসরণ করবেন। স্বাভাবিকভাবে বিবাহ পূর্বে পিতা-মাতার অনুমতি নেওয়া উচিত, আর বিবাহিত হলে স্বামীর অনুমতি নেওয়া ভালো। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয় বিশেষ করে যদি রোগীর অবস্থা সংকটজনক হয়। পাশাপাশি একান্ত প্রয়োজনে নন-মাহরাম কাউকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি পর্দা লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকে, কিংবা রক্তদাতা বা গ্রহীতার মধ্যে ফিতনার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে অবশ্যই রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। কারণ, সাধারণত মানুষ এমন ব্যক্তির প্রতি দুর্বল হয়, যে তার উপকার করে। এছাড়া, একজন নারী এমন ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, যার সঙ্গে তার স্বামীর শত্রুতা বা মনোমালিন্য রয়েছে, কিংবা যার ব্যাপারে স্বামী অসন্তুষ্ট। কেননা, এমন ব্যক্তিকে রক্ত দিলে স্বামী স্ত্রীর ওপর ক্রোধান্বিত হতে পারেন, যা তাদের দাম্পত্য জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অথচ মানুষের উপকার করার চেয়ে স্বামীকে খুশি রাখা ও নিজের দাম্পত্য জীবন রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।রক্তদান সংক্রান্ত কয়েকটি ফাতওয়া লক্ষ্য করুন।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,

التبرع بالدم جائز إذا كان لا يؤثر على صحة المتبرع، لكن إذا ترتب عليه إنقاذ معصوم ولا يوجد غيره فإنه يجب والحالة هذه.

“যদি রক্তদান করা দাতার স্বাস্থ্যের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে তাহলে তা জায়েজ। তবে যদি এতে কোনো ‘মাসুম’ (অপরাধমুক্ত বা যার রক্ত প্রবাহ বৈধ) ব্যক্তির জীবন রক্ষা হয় এবং তার জীবন বাঁচানোর অন্য কোনো উপায় না থাকে, তাহলে এই পরিস্থিতিতে রক্তদান করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ৭৫)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]–কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “আমি কি এমন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্তদান করতে পারি, যে প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে অথচ সে ইসলামের অনুসারী নয়?”

তিনি উত্তরে বলেন:

“…. فإذا اضطر المعاهد أو الكافر المستأمن الذي ليس بيننا وبينه حرب، إذا اضطر إلى ذلك فلا بأس بالصدقة عليه من الدم، كما لو اضطر إلى الميتة، وأنت مأجور في ذلك; لأنه لا حرج عليك أن تسعف من اضطر إلى الصدقة” ا

“যদি কোনো ‘মুয়াহাদ’ (অর্থাৎ যে অমুসলিমের সঙ্গে মুসলিমদের চুক্তি রয়েছে) বা ‘মুস্তাআমান’ (অর্থাৎ যে মুসলিমদের নিরাপত্তার অধীনে রয়েছে), যার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ নেই, সে যদি চরম বিপদের সম্মুখীন হয়, তাহলে তাকে রক্ত দান করা জায়েজ। এটি তেমনই যেমন কেউ ক্ষুধার কারণে চরম বাধ্য হয়ে মৃত পশুর গোশত খেতে বাধ্য হয়। তুমি যদি এমন কাউকে রক্ত দান করো, তবে এতে তোমার জন্য সওয়াব রয়েছে; কারণ চরম প্রয়োজনের মুহূর্তে কাউকে সাহায্য করা বৈধ এবং এতে কোনো বাধা নেই।”(ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব)
.
ইসলাম ওয়েবের আলেমগনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: একবার আমি রক্ত দান করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি একজন পুরুষ ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে আমার হাতের একটি অংশ তার সামনে উন্মুক্ত করতে হয়েছিল। আমি তো একটি সৎ কাজ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এর সঙ্গে যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু অসুবিধাও জড়িয়ে গেল। এখন আমি উদ্বিগ্ন যদি আল্লাহ আমার এই কাজ গ্রহণ না করেন! যদিও আমি একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই এটি করতে চেয়েছিলাম। তাহলে কি এই কারণে আমি গুনাহগার হয়েছি? আমার পরিণতি কী হবে?

জবাবে তারা বলেন:

فإن التبرع بالدم من فضائل الأعمال عند الحاجة، وليس من الواجبات ما لم تكن هناك ضرورة، وكشف المرأة لذراعها محرم، فلا يسوغ ارتكاب المحرمات من أجل المستحبات والفضائل، وعلى ذلك فإن أدى تبرع المرأة بالدم إلى تكشفها أمام رجل أجنبي أو لمسه لها لم يجز لها التبرع، وتأثم بذلك، ما لم تكن هناك ضرورة تجعل التبرع متعينا عليها. ونسأل الله سبحانه وتعالى أن يعفو عنك بفضله ورحمته، وأن يأجرك على ما في قلبك من خير.

“রক্তদান প্রয়োজনের সময়ে সওয়াবের কাজগুলোর অন্তর্ভুক্ত তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়, যদি না জরুরি অবস্থা দেখা দেয়। একজন নারীর জন্য বাহু প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, তাই নফল বা নেক কাজের জন্য হারাম কাজ করা বৈধ নয়। সুতরাং, যদি কোনো নারী রক্তদান করতে গিয়ে কোনো নন-মাহরাম পুরুষের সামনে বাহু প্রকাশ করতে বাধ্য হয় বা সে পুরুষ তাকে স্পর্শ করে তাহলে তার (নারীর) জন্য রক্তদান করা বৈধ হবে না, এবং এতে সে গুনাহগার হবে যদি না এটি চূড়ান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে প্রার্থনা করি যে তিনি আপনাকে তাঁর অনুগ্রহ ও দয়ার মাধ্যমে ক্ষমা করুন এবং আপনার অন্তরের সদিচ্ছার জন্য পুরস্কৃত করুন।”(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১২৩২৫০) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
আপনাদের দ্বীনি ভাই:

জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি আবহা, সৌদি আরব।

Share: