প্রশ্ন: মিসওয়াক করার বিধান কী? কোন হাতে মিসওয়াক করা উচিত? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মিসওয়াক শব্দের আভিধানিক অর্থ: ঘষা, মাজা বা মর্দন করা ইত্যাদি। مِسْوَاكُ “মিসওয়াক” হলো প্রত্যেক সে কাষ্ঠ খন্ড যা দ্বারা ঘর্ষণের মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার করা হয়।পরিভাষায়ঃ দাঁত থেকে খাদ্যকনা, হলুদ বর্ণ এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য কাঠি, ডাল বা অনুরূপ কিছু দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করাকে মিসওয়াক বলে।(শাওকানী; নাইলুল আওতার; খন্ড; ১ পৃষ্ঠা; ১০২) মিসওয়াক করার উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা হচ্ছে মুখ পরিষ্কার রাখা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়’। এছাড়াও মিসওয়াকের আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন: মিসওয়াক করলে দাঁত মযবুত হয়, মাঢ়ি মযবুত হয়, কন্ঠ পরিষ্কার হয় এবং মনে প্রফুল্লতা আসে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মিসওয়াকের বিধান দেওয়া হয়েছে মুখকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য।(শরহ উমদাতুল ফিক্বহ; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা; ২১৮) আলেমদের মতে মুখ পরিষ্কারের জন্য সর্বোত্তম জিনিস হল আরক গাছের ডাল, কারণ এর সুগন্ধ রয়েছে এবং এতে ব্রাশের মতো ফাইবার রয়েছে যা দাঁতের মাঝখান থেকে খাদ্য কণা ইত্যাদি পরিষ্কার করার জন্য কার্যকরী ভুমিকা পালন করে।প্রখ্যাত সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৩২ হি.] থেকে বর্নিত তিনি বলেন,”আমি রাসূল (ﷺ)-এর জন্য আরক গাছ থেকে সিওয়াকের লাঠি সংগ্রহ করতাম”।(মুসনাদে আহমেদ হা/৩৯৯১ সনদ হাসান) তবে আরাক ডাল পাওয়া না গেলে, যেকোন গাছের তরতাজা ডাল,যা মুখকে ক্ষত করে না এমন বস্ত্ত দ্বারা মিসওয়াক করা যথেষ্ট হবে। যেমন নির্দিষ্ট কোন পেষ্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।[আল-মুলাক্ষাছুল ফিক্বহী, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা; ৩৫ পৃঃ, আল-ফিক্বহুল মুয়াসসার; পৃষ্ঠা: ১৪)
.
▪️মিসওয়াক করার হুকুম কী:
রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত একাধিক মারফূ হাদীসের আলোকে চারটি মাজহাব, হানাফি, মালিকী, শাফঈ এবং হাম্ভলী মাজহাবের ইজমা তথা ঐক্যমত অনুযায়ী মিসওয়াক করা ফিত্বরাহ্ অর্থাৎ প্রকৃতিগত স্বভাবের অন্তর্গত একটি সুস্পষ্ট সুন্নত। হাদীস থেকে দলিল হচ্ছে,আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন:” عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ، وَنَتْفُ الْإِبِطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ ” قَالَ زَكَرِيَّا: قَالَ مُصْعَبٌ: وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ “১০ টি বিষয় ফিতরাতের (স্বভাবযাত) অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, অঙ্গের গিরাসমূহ ঘষে মেজে ধৌত করা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা, নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করা, মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা তথা ইসতিনজা করা। যাকারিয়া বলেন, মাস‘আব বলেছেন: আমি দশ নম্বরটি ভুলে গেছি। সম্ভবতঃ তা হলো কুলি করা।[সহীহ মুসলিম হা/৪৯২; আবূ দাউদ হা/ ৫২, তিরমিযী ৬/২৯ নাসাঈ ৮/১২৬; ইবনে মাজাহ হা/ ২৯৩) অপর বর্ননায় আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ,لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بتأخير العشاء وبالسواك عند كل صلاة، “যদি আমি আমার উম্মতের জন্য কঠিন মনে না করতাম তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।”(সহীহ বুখারী হা/ ৮৮৭, সহীহ মুসলিম হা/২৫৩; আবু দাউদ হা/৪৬ মিশকাত হা/৩৭৭)। অপর বর্ননায় আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ- “মিসওয়াক হচ্ছে- মুখ পবিত্রকারী ও রব্বকে সন্তুষ্টকারী”[মুসনাদে আহমাদ হা/২৪২০৩; সুনানে নাসাঈ হা/৫; সহীহুত তারগীব ২০৯, মিশকাত হা/৩৮১: ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন)
.
প্রিয় পাঠক! উল্লিখিত হাদীসসমূহ থেকে মিসওয়াকের গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। হাদীসে মিসওয়াকের এত গুরুত্ব দেয়ার বহুবিদ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল স্বাস্থ্যগত কারণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ও নির্দেশ মত যদি কেউ প্রত্যেক সালাতের পূর্বে এবং ঘুম থেকে উঠে নিয়মিত মিসওয়াক করে তাহ’লে তার দাঁত ঝকঝকে থাকবে এবং সে যাবতীয় দন্ত রোগ থেকে মুক্ত থাকবে। কথায় বলে দাঁতের সাথে আঁতের সম্পর্ক। দাঁত ভালো তো আতঁ ভালো, আর আতঁ ভালো তো সব ভালো।
.
▪️কখন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মিসওয়াক করা সুন্নাহ?
.
মুখপরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মিসওয়াক। মিসওয়াকের মাধ্যমে মুখের দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় এবং দন্ত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মিসওয়াক রাত-দিন সকাল সন্ধ্যা যেকোন সময়ই করা যায়। এমনকি রোজা অবস্থায়ও মিসওয়াক করা যায়। কারন আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ- “মিসওয়াক হচ্ছে- মুখ পবিত্রকারী ও রব্বকে সন্তুষ্টকারী”[মুসনাদে আহমাদ হা/২৪২০৩; সুনানে নাসাঈ হা/৫; সহীহুত তারগীব ২০৯, মিশকাত হা/৩৮১) এই হাদীসে মিসওয়াক করা কোন সময়ের সাথে খাস করা হয়নি তবে উসূলবিদ ইমামগন এ সংক্রান্ত হাদীসগুলোর আলোকে মিসওয়াক করার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সময় উল্লেখ করেছেন আর তা হচ্ছে:
.
(১) ঘুম থেকে জেগে: ঘুম থেকে জেগে মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ يَشُوْصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে মিসওয়াক করতেন।
(২) প্রত্যেক অযুর সময় মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূল ﷺ বলেছেন, لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِيْ لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ وُضُوْءٍ».“আমার উম্মতের জন্য আদেশটি মানা যদি কষ্টকর না হতো তাহলে আমি ওদেরকে প্রত্যেক অযুর সময় মিসওয়াক করতে আদেশ করতাম”(মুসনাদে আহমাদ, হা/ ৪০০,৪৬০)
(৩) প্রত্যেক সালাতের সময় মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূল ﷺ বলেন,لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِيْ أَوْ عَلَى النَّاسِ لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ».“আমার উম্মত বা সকলের জন্য আদেশটি মানা যদি কষ্টকর না হতো তাহলে আমি ওদেরকে প্রত্যেক সালাতের সময় মিসওয়াক করতে আদেশ করতাম”।(সহীহ বুখারী হা/ ৮৮৭)
(৪) ঘরে বা মাসজিদে ঢুকার সময় মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। আম্মাজান আয়শা রাঃ বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ بَدَأَ بِالسِّوَاكِ».“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করেই মিসওয়াক করা আরম্ভ করতেন”।(সহীহ মুসলিম হা/২৫৩)
(৫) মুখ দুর্গন্ধ, রুচি পরিবর্তন কিংবা দীর্ঘকাল পানাহারবশত দাঁত হলুদবর্ণ হলে উক্ত মুহূর্তগুলোতে মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। কারণ, মিসওয়াকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুখগহবরকে পরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধমুক্ত রাখা। তেমনিভাবে যদি ঘুম থেকে জাগার পর মিসওয়াক করতে হয় তাহলে এ মুহূর্তগুলোতেও মিসওয়াক করা অবশ্যই কর্তব্য।(সহীহ বুখারী হা/২৪৬,মুসনাদে আহমাদ হা/২৪২০৩)
(৬) কুরআন মাজীদ পড়ার সময়ও মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূল ﷺ বলেন,«إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا تَسَوَّكَ ثُمَّ قَامَ يُصَلِّيْ قَامَ الْـمَلَكُ خَلْفَهُ فَيَسْتَمِعُ لِقِرَاءَتِهِ فَيَدْنُوْ مِنْهُ – أَوْ كَلِمَةٌ نَحْوُهَا – حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيْهِ فَمَا يَخْرُجُ مِنْ فِيْهِ شَيْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ إِلاَّ صَارَ فِيْ جَوْفِ الْـمَلَكِ، فَطَهِّرُوْا أَفْوَاهَكُمْ لِلْقُرْآنِ»“বান্দা যখন মিসওয়াক করে সালাতে দাঁড়ায় তখন একজন ফিরিস্তা তার পেছনে দাঁড়িয়ে কিরাআত শ্রবণ করতে থাকে। এমনকি ফিরিস্তা নামাযীর খুব নিকটে গিয়ে নিজ মুখ নামাযীর মুখে রাখে। তাতে করে নামাযীর মুখ থেকে কুর‘আনের কোনো অক্ষর বেরুতেই তা ফিরিস্তার পেটে চলে যায়। তাই তোমরা কুরআন পাঠের উদ্দেশ্যে নিজ মুখগহবর পরিচ্ছন্ন কর”(সাহীহুত তারগীব হা/ ২১৫; সিলসিলা সাহীহা হা/১২১৩)
(৭) জিহ্বার উপর মিসওয়াক করা মুস্তাহাব।আবু মূসা আশ‘আরী বলেন,نَسْتَحْمِلُهُ فَرَأَيْتُهُ يَسْتَاكُ عَلَى لِسَانِهِ “আমি রাসূল (ﷺ)-কে জিহবার উপর মিসওয়াক করতে দেখেছি”(আবু দাউদ, হা/৪৯)
(৮) সিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক করা যায়।
ইবনু ওমর (রাঃ) সিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক করাকে অন্যায় মনে করতেন না (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৯২৪১, সনদ সহীহ)।শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: সঠিক মতানুযায়ী দিবসের প্রথমভাগে হোক বা শেষভাগে হোক রোজাদারের জন্য মিসওয়াক করা সুন্নত।[ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ৪৬৮] (৯).মিসওয়াক করার পর মিসওয়াকটি ধুয়ে নিতে হয়। আম্মাজান আয়শা রাঃ বলেন, রাসূল (ﷺ) মিসওয়াক করে মিসওয়াকটি আমাকে ধোয়ার জন্য দিতেন। কিন্তু আমি মিসওয়াকটি না ধুয়ে বরং তা দিয়ে মিসওয়াক করতাম। পরিশেষে মিসওয়াকটি ধুয়ে রাসূল (ﷺ)-কে ফেরত দিতাম”(আবূ দাঊদ ৫২)
.
▪️কোন হাতে মিসওয়াক করা উচিত?
.
কোন হাত দিয়ে মিসওয়াক করা উত্তম এই মর্মে রাসূল (ﷺ)-থেকে বিশুদ্ধ কোন হাদীস বর্নিত হয়নি,তাই এই বিষয়টি ফিকাহবিদদের মধ্যে একটি মশহুর মতভেদপূর্ণ বিষয়। জমহুর তথা হানাফী, মালেকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলী মাজহাবের দুটি মতের অপেক্ষাকৃত দুর্বল মত অনুযায়ী ডান হাত দিয়ে মিসওয়াক করা মুস্তাহাব। তাদের মতের পক্ষে তারা যে দলিল দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে, আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِيْ تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুতা পরিধান, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক হতে আরম্ভ করতে পছন্দ করতেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৬৮)। তিনি আরো বলেন, كَانَتْ يَدُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْيُمْنَى لِطُهُوْرِهِ وَطَعَامِهِ وَكَانَتْ يَدُهُ الْيُسْرَى لِخَلَائِهِ وَمَا كَانَ مِنْ أَذًى ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডান হাত ছিল পবিত্রতা অর্জন ও খাদ্য গ্রহণের জন্য। আর তাঁর বাম হাত ছিল শৌচ ও অন্যান্য নিকৃষ্ট বা কষ্টদায়ক কাজের জন্য। (আবু দাঊদ হা/৩৩; মিশকাত, হা/৩৪৮) উক্ত হাদীসের আলোকে আলেমগন বলেন মিসওয়াক করা একটি ইবাদত এবং এটি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম,তাই এটি ডান হাতে করা উচিত, বাম হাতে করা উচিত নয়।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
باب استحباب تقديم اليمين في كل مَا هو من باب التكريم ؛ كالوضوءِ وَالغُسْلِ وَالتَّيَمُّمِ ، وَلُبْسِ الثَّوْبِ وَالنَّعْلِ وَالخُفِّ وَالسَّرَاوِيلِ وَدُخولِ الْمَسْجِدِ ، وَالسِّوَاكِ ، وَالاكْتِحَالِ ، وَتقليم الأظْفار ، وَقَصِّ الشَّارِبِ ، وَنَتْفِ الإبْطِ ، وَحلقِ الرَّأسِ ، وَالسّلامِ مِنَ الصَّلاَةِ ، وَالأكْلِ ، والشُّربِ ، وَالمُصافحَةِ ، وَاسْتِلاَمِ الحَجَرِ الأَسْوَدِ ، والخروجِ منَ الخلاءِ ، والأخذ والعطاء وغيرِ ذَلِكَ مِمَّا هُوَ في معناه . ويُسْتَحَبُّ تَقديمُ اليسارِ في ضدِ ذَلِكَ ، كالامْتِخَاطِ وَالبُصَاقِ عن اليسار ، ودخولِ الخَلاءِ ، والخروج من المَسْجِدِ ، وخَلْعِ الخُفِّ والنَّعْلِ والسراويلِ والثوبِ ، والاسْتِنْجَاءِ وفِعلِ المُسْتَقْذرَاتِ وأشْبَاه ذَلِكَ ” انتهى .
“শরী‘আতে এটি একটি চলমান রীতি যে, জামাকাপড়, ট্রাউজার এবং মোজা পরিধান করা, মসজিদে প্রবেশ করা, মিসওয়াক করা, চোখে সুরমা লাগানো, নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, চুল আঁচড়ানো, বগলের চুল উপড়ানো, মাথা কামানো, সালাত শেষে সালাম ফিরানো, ওযুতে অঙ্গ ধুয়ে ফেলা, টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসা, খাওয়া-দাওয়া, মুছাফাহ, হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন দেয়া ইত্যাদিতে ডান ব্যবহার করা বা ডানদিক থেকে শুরু করা মুস্তাহাব। এর বিপরীত বিষয়গুলো যেমন, টয়লেটে প্রবেশ করা, মসজিদ থেকে বের হওয়া, নাক মুছা, টয়লেট ব্যবহারের পরে নিজেকে পরিষ্কার করা, কাপড়, ট্রাউজার এবং মোজা খুলে ফেলা ইত্যাদিতে বাম হাত ব্যবহার করা বা বাম দিক থেকে শুরু করা মুস্তাহাব। (ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬০; রিয়াদুস সালেহীন খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪০৫, শামসুল হক আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৫)।
.
অপরদিকে হাম্বালি মাজহাবের শক্তিশালী মতামতসহ অপর একদল আলেমদের মতামত অনুযায়ী মিসওয়াক বাম হাতে করা মুস্তাহাব। এই মতের পক্ষে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, বিগত শতাব্দীর অন্যতম ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) রয়েছেন। তারা বলেন, মিসওয়াক বাম হাতে করা উত্তম এর কারন হচ্ছে, মিসওয়াক করার মাধ্যমে দাঁতের ময়লা দুর করা হয় সুতরাং এটি এটি ময়লা অপসারণ তথা অপছন্দনীয় কাজে ব্যবহারের শিরোনামে আসে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইবনে তাইমিয়া; আল-ইখতিয়ারাত, পৃষ্ঠা: ১০)।
.
উপরোক্ত দুটি মতের সমন্বয়ে অপর একদল আলেম বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যখন সুন্নাত অনুসরণের নিয়তে মিসওয়াক ব্যবহার করে তখন তার ডান হাত ব্যবহার করা উচিত এবং যদি সে দাঁতের ময়লা অপসারণের উদ্দেশ্যে মিসওয়াক করে তবে তার বাম হাত ব্যবহার করা উচিত। আর যেহেতু কোন হাতে মিসওয়াক করা সুন্নাহ এই মর্মে বিশুদ্ধ কোন বর্ণনা নেই তাই এক্ষেত্রে বিষয়টি প্রশস্ত; যেকোনো একটি মত গ্রহণ করা বৈধ।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল
উপস্থাপক: অধিক উত্তম কোনটি, ডান হাত দ্বারা মিসওয়াক করা নাকি বাম হাত দ্বারা?
শায়খ জবাবে বলেন,
الاستياك باليُسرى، يستاك باليسرى؛ لأنه إزالة أذى، واليسرى للأذى، لكن يبدأ بالشقِّ الأيمن، في حديث عائشة رضي الله عنها: كان النبي ﷺ يُعجبه التَّيمن في تنعله وترجله وسواكه وطهوره وفي شأنه كله، فيبدأ بالشقِّ الأيمن في السِّواك.
“ক্ষেত্রটি মূলত বাম হাত দ্বারা মিসওয়াক করা, তাই অবশ্যই সে বাম হাত দ্বারা মেসওয়াক করবে; এর কারণ হলো এটি মূলত ময়লা দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। আর বাম হাত মূলত ময়লা দূরীভূত করার জন্যই হয়ে থাকে। তবে অবশ্যই সে মিসওয়াক করার সময় ডানপার্শ থেকে শুরু করবে। কারণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত তিনি বলেন; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুতা পরা, চুল আঁচড়ানো, মিসওয়াক করা, পবিত্র হওয়া ও ইত্যাদি যাবতীয় কার্যকলাপের সময় ডান দিক থেকে শুরু করতেন।সুতরাং মেসওয়াক করার সময় সে ডান দিক থেকে শুরু করবে।(বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৩১৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: ডান হাত দ্বারা মিসওয়াক করতে হয় নাকি বাম হাত দ্বারা?
উত্তরে শাইখ বলেন:
هذا محل خلاف، فذهب بعض العلماء إلى أن الإنسان يستاك باليد اليمنى، لأن السواك سنة والسنة طاعة لله وقربة فلا تتناسب أن تكون باليد اليسرى لأن اليسرى تقدم للأذى. وقال آخرون: بل باليد اليسرى أفضل، وذلك لأن السواك لإزالة الأذى، وإزالة الأذى تكون باليسرى كالاستنجاء والاستجمار فإنه يكون باليسرى لا باليمنى. وفضَّل آخرون فقالوا: إن تسوَّك لتطهير الفم كما لو استيقظ من نوم أو لإزالة أذى، فيكون باليد اليسرى لأنه لإزالة الأذى، وأن تسوَّك لتحصيل السنة، فيكون باليمنى لأنه مجرد قربة كما لو كان قد توضأ قريبًا واستاك، فإنه يستاك باليمنى، والأمر ولله الحمد في هذا واسع، فيستاك كما يريد لأنه ليس في المسالة نص واضح.
“এটি মতভেদপূর্ণ মাসয়ালা। সুতরাং কতিপয় আলেম মত দিয়েছেন যে, মানুষ ডান হাত দ্বারা মিসওয়াক করবে। কারণ মিসওয়াক করা সুন্নাত। আর সুন্নাত আল্লাহর আনুগত্য এবং নৈকট্য হাসিল করার মাধ্যম। সুতরাং বাম হাত দ্বারা মিসওয়াক করা অনুপযুক্ত। কারণ বাম হাত ময়লার জন্য উন্মুক্ত। আবার কতিপয় আলেম বলেন, বরং বাম হাত দ্বারা মেসওয়াক করা উত্তম। এর কারণ হলো, মেসওয়াক মূলত ময়লা দূরীভূত করার জন্য করা হয়। আর ময়লা দূরীভূত করা মূলত বাম হাতের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন ইস্তেঞ্জা করা ও মলমূত্র ত্যাগের পর পাথর দ্বারা পবিত্র হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং তা মূলত বামহাত দ্বারা হবে, ডান হাত দ্বারা নয়। আবার কতিপয় আলেম উত্তম বলে এ কথা বলেন যে, যদি কোন ব্যক্তি মুখ পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে মেসওয়াক করে, যেমন কেউ যদি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়, অথবা ময়লা দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে, তাহলে বাম হাত দ্বারা মেসওয়াক করা বেশি উত্তম। কারণ তা ময়লা দূরীভূত করার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আর যদি সে সুন্নত পালনের উদ্দেশ্যে মিসওয়াক করে, তাহলে ডান হাত দ্বারা মেসওয়াক করতে হবে। কারণ তার শুধুমাত্র নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। যেমন কেউ যদি ওযু করে এবং মিসওয়াক করে, তাহলে অবশ্যই সে ডান হাত দ্বারা মিসওয়াক করবে। আর আদেশের বিষয়টিতে ওয়ালিল্লাহিল হামদ, প্রশস্ত রয়েছে। সুতরাং সে মিসওয়াক করবে, যেমনভাবে সে চায়। কারণ এই মাসআলার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোন দলিল পাওয়া যায় না।(উসাইমীন; মাজমুঊ ফাতওয়া ওয়া রাসায়িল, খন্ড: ১১ পৃষ্ঠা: ১১৫)।
.
আমাদের শায়খ মুহাম্মাদ মুহাম্মদ আল-মুখতার আশ-শানক্বিত্বী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ফলে তিনি এর দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন যার সারমর্ম হল:
,فأجاب جواباً طويلا ملخصه: أنه إن استاك ينوي السنة فليستك باليمنى وإن استاك ينوي تطهير وتنظيف فمه فغنه يستاك باليسرى والأمر واسع
“যখন সে সুন্নাত পালনের নিয়তে মিসওয়াক করবে, তখন সে যেন ডান হাত দ্বারা মিসওয়াক করে। আর যখন সে পবিত্র ও মুখ পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে মেসওয়াক করবে, তখন সে বাম হাত দ্বারা মিসওয়াক করবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি প্রশস্ত।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, শরী‘আতে মিসওয়াক করার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু কোন হাতে মিসওয়াক করা সুন্নাহ এই মর্মে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই। আমাদের কাছে ইবনে উসাইমিন (রহঃ)-এর ফাতওয়াটি অধিক গ্রহনযোগ্য বলে মনে হয় (আল্লাহু আলাম)। সুতরাং বিশুদ্ধ দলিল বিহীন ফেসবুকে একতরফা বামহাতে মিসওয়াক করা সুন্নাহ বলে প্রচার করা সঠিক হয়েছে বলে মনে হয়না। যাইহোক, পাশাপাশি আরো একটি বিষয় জানা উচিত আর তা হচ্ছে, ইসলামি শরী‘আতে মিসওয়াক করার গুরুত্ব অনেক। একথা সঠিক কিন্তু মিসওয়াক করার বিভিন্ন ফযীলত সম্পর্কে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয় তার সবগুলোই জয়ীফ কিংবা জাল। যেমন: প্রসিদ্ধ আছে “যে সালাত মিসওয়াক করে আদায় করা হয়, সেই ছালাতে মিসওয়াক করা বিহীন সালাতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী নেকী হয়”।(বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৫৯, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬১-৬২; হাকেম হা/৫১৫) হাদীসটি সহীহ নয় বরং জয়ীফ।কারণ এর সানাদে মু‘আবিয়াহ্ ইবনু ইয়াহ্ইয়া আস্ সদাকী নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে। এছাড়াও এর অন্য একটি সানাদে ওয়াক্বিদী নামে একজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে। বিস্তারিত জানতে দেখুন সিলসিলা জয়ীফা হা /১৫০৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।