ভূমিকা: সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাঁর কাছে স্বীয় কু-প্রবৃত্তি ও অসৎ কর্মের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই। তিনি যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত দান করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনুসারীর উপর। অতঃপর একজন সালাফি আলেম ইসলামী শরীয়তের হুকুম আহকামের বিধি বিধানের সঠিক নীতিমালা তুলে ধরার নিয়তে বিদআতী আলেমদের সাথে সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা সালাফি মানহাজের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা বিষয়টি ব্যাখ্যা সাপেক্ষে। যেমন: একজন সুন্নাহপন্থী আলেম বিদআতি আলেমদের সাথে দ্বীনি সভা সেমিনারে অংশগ্রহণের দুটি অবস্থা/বিষয় লক্ষণীয়। (১). তিনি যাদের সাথে দ্বীনি মজলিস, সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বিদআত কুফরির অন্তর্ভুক্ত কিনা! (২). তিনি বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের যোগ্য আলেম কিনা এবং বিদআতিদের সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তার নিয়ত তথা উদ্দেশ্য কী? এবার এই দুটি বিষয়ের মর্ম বুঝার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
১). তিনি যাদের সাথে সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বিদআত কুফরির অন্তর্ভুক্ত কিনা!?
.
দুঃখ জনক হলেও সত্যি আমরা অনেকেই বিদআতী নাম শুনলেই সকল বিদআতিকে এক পাল্লায় মাফতে শুরু করি এবং ঢালাওভাবে তাদেরকে বর্জনের জন্য উঠেপড়ে লাগি। আর তাদেরকে বর্জন অপরিহার্য প্রমাণ করার জন্য সালাফদের থেকে বর্নিত আচার, ফাতওয়াগুলো উল্লেখ করি যা মোটেও কাম্য নয়। জানা আবশ্যক যে, সকল বিদআত এক পর্যায়ের নয়। কিছু আছে শিরক ও কুফরি পর্যায়ের জঘন্য বিদআত আর কিছু আছে তুলনামূলক ভাবে হালকা বিদআত যা কুফুরি পর্যায়ের নয়। সুতরাং সকল বিদআতির হুকুম যেমন এক নয় তেমনি তাদের সাথে আচরণও একরকম হবেনা বরং তাদের সাথে তাদের বিদআতের প্রকার ও মাত্রার ভিত্তিতে আচরণ ভিন্ন ভিন্ন হবে। যে যেই অপবাদের প্রাপ্য নয় তাকে সেখানে ফিট করা তার প্রতি এক ধরনের জুলুম। তাই কোন লোককে বিদআতী বলার আগে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী এবং বিদআত ও বিদাতকারীর মধ্যে পার্থক্য করা উচিত। কেননা হতে পারে ব্যক্তি অজ্ঞতা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার কারণে তার অজুহাত গ্রহণযোগ্য। বিভিন্ন দেশের প্রচলিত বিদ‘আত সাধারণত দু’ধরনের। যথা: (১) আক্বীদাগত বিদ‘আত: যার মাধ্যমে উক্ত বিদ‘আতপন্থী ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। যেমন: চরমপন্থী খারেজী, রাফেযী, ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা ও জাহমিয়াদের বিদআত। (২) আমলগত বিদআত: যার মাধমে উক্ত বিদ‘আতপন্থী ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় না।কিন্তু গোনাহগার হবে। সুতরাং যে সকল ব্যক্তিদের বিদআত কুফুরি ও শিরকি পর্যায়ের তাদের সাথে দাওয়াতী মাঠে বা সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ একজন সুন্নাহপন্থী আলেমের জন্য জায়েজ নয়। বরং তাদেরকে বর্জন করা অপরিহার্য। কেননা আমাদের ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের সর্বজনগৃহীত একটি মূলনীতি ছিল আক্বীদাগত বিদ‘আতীদের সাথে কেউ যেন ওঠাবসা বা চলাফেরা বা মেলামেশা না করে। এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের একটি অন্যতম মূলনীতি। আহলুস সুন্নাহ’র ইমাম শাইখুল ইসলাম, হাফিয আবূ ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] আহলুস সুন্নাহ’র মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, أصول السنة عندنا : ترك الخصومات والجلوس مع أصحاب الأهواء. “আমাদের নিকট সুন্নাহ’র মূলনীতি হচ্ছে, বিদ‘আতীদের সাথে তর্কবিতর্ক এবং (তাদের সাথে) ওঠাবসা বর্জন করা।” [ইমাম আহমাদ উসূলুস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৩; ইমাম আল-লালাকাঈ (রশারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ৩১৭; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৮) মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আল-ক্বাহত্বানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,فأما من كانت بدعته كفرية أو شركية فهذا يتبرأ منه ويهجر هجرًا نهائيًا وليس له أي موالاة بل البراءة منه كالبراءة من الكافر الأصلي أو المشرك. وأما من كانت بدعته دون ذلك أي من المعاصي والذنوب التي لا تصل إلى حد الكفر أو الشرك فهذه تختلف أيضًا باختلاف الأشخاص والأزمان”বিদ‘আতীর বিদ‘আত যদি কুফরী বা শিরকী বিদ‘আত হয়, তাহলে তার সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করতে হবে; তার জন্য কোন প্রকার মৈত্রি থাকবে না। বরং মূল কাফের এবং মুশরিকের সাথে যেমন পুরোপুরি সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করতে হয়, তার সাথেও ঠিক তা-ই করতে হবে। পক্ষান্তরে যার বিদ‘আত পাপ ও গুনাহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে এবং কুফর বা শিরক পর্যন্ত পৌঁছবে না, তার সাথে ব্যক্তি ও সময় অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে”।(মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আল-ক্বাহতানী, আল-অলা ওয়াল-বারা ফিল ইসলাম (রিয়াদ: দারু ত্বাইয়েবা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৪১৩ হি.), পৃষ্ঠা: ৩০৮)
.
উপরোক্ত মূলনীতি গৃহীত হয়েছে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাঁদের পরবর্তী অনুসারীগণ কর্তৃক অবলম্বিত মানহাজ থেকে। আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৮ হি.] থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “এক ব্যক্তি নাবী ﷺ এর নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি লোকটিকে দেখে বললেন, ‘সে সমাজের নিকৃষ্ট লোক এবং সমাজের দুষ্ট সন্তান।’ এরপর সে যখন এসে বসল, তখন নাবী ﷺ আনন্দ সহকারে তার সাথে মেলামেশা করলেন। লোকটি চলে গেলে ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যখন আপনি লোকটিকে দেখলেন তখন তার ব্যাপারে এমন বললেন,পরে তার সাথেই আপনি আনন্দচিত্তে সাক্ষাৎ করলেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “হে ‘আয়িশাহ, তুমি কখনো আমাকে অশালীন দেখেছ? কেয়ামতের দিন আল্লাহ’র কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যার দুষ্টামির কারণে মানুষ তাকে ত্যাগ করে।”(সহীহ বুখারী, হা/৬০৩২; সাহীহ মুসলিম, হা/২৫৯১) প্রখ্যাত তাবি‘ঈ, মাদীনাহ’র শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ও মুফতী, ইমাম সুলাইমান বিন ইয়াসার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১০৭ হি.] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “বানূ তামীম গোত্রে সাবীগ বিন ‘ইসল নামে এক ব্যক্তি ছিল। একবার সে মাদীনাহ’য় আগমন করে। তার কাছে বেশ কিছু গ্রন্থ ছিল। সে লোকদেরকে কুরআনের মুতাশাবিহ তথা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল। ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি তাকে ডেকে পাঠান। আর তার জন্য তিনি খেজুর গাছের (কাঁদির) অনেকগুলো শুকনো দণ্ড প্রস্তুত করেন। সে যখন তাঁর নিকটে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ করে, তখন তিনি বলেন, ‘তুমি কে?’ সে বলে, ‘আমি আল্লাহ’র গোলাম সাবীগ।’ ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, ‘আর আমি হলাম আল্লাহ’র গোলাম ‘উমার।’ এই বলে তিনি তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ওই প্রস্তুতকৃত শুকনো খর্জূর দণ্ডগুলো দিয়ে পিটাতে লাগলেন। তিনি তাকে মারতেই থাকলেন, এমনকি মারতে মারতে তার মাথা ফাটিয়ে দিলেন, আর ওই ব্যক্তির মুখ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। সে বলল, ‘আমীরুল মু’মিনীন, যথেষ্ট হয়েছে। আল্লাহ’র কসম, আমার মাথায় যা (ভ্রান্ত বিশ্বাস) ছিল তা উধাও হয়ে গেছে’।”(ইমাম আল-লালাকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ১১৩৮; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৬০) যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বলেছেন, لا تجالس أهل الأهواء فإن مجالستهم ممرضة للقلوب. “তুমি বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা কোরো না। কেননা তাদের সাথে ওঠাবসা অন্তরে রোগ সৃষ্টি করে।”(ইমাম ইবনু বাত্বত্বাহ, আল-ইবানাহ; আসার নং: ৩৭১] প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আওযা‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৫৭ হি.] কে বলা হলো, إن رجلاً يقول: أنا أجالس أهل السنة وأجالس أهل البدع، فقال الأوزاعي: هذا رجل يريد أن يساوي بين الحق والباطل. “এক ব্যক্তি বলছে, ‘আমি আহলুস সুন্নাহ’র সাথেও ওঠাবসা করি, আবার বিদ‘আতীদের সাথেও ওঠাবসা করি।’ তখন আওযা‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, ‘এই লোক হক এবং বাতিলকে সমান করতে চাচ্ছে’।”(আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪৩০) এই আসারটি বর্ণনা করার পর ইমাম ইবনু বাত্বত্বাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩৮৭ হি.] বলেছেন, “আওযা‘ঈ সত্যই বলেছেন। আমি বলছি, এই ব্যক্তি হক ও বাতিলের এবং ঈমান ও কুফরের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নয়। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং নাবী ﷺ থেকে সুন্নাহ বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ “যখন তারা মু’মিনদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’; আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের (সর্দারদের) সঙ্গে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি’।”(সূরাহ বাক্বারাহ: ১৪)” (আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪৩০ এর টীকা অনুবাদ সংকলিত) অতএব আক্বীদাগত তথা যাদের বিদআত কুফরি পর্যায়ের দ্বীনের স্বার্থে তাদেরকে বর্জন করা সালাফী মানহাজের অন্তর্ভুক্ত।
.
(২). যে সুন্নাহপন্থী আলেম বিদআতিদের সাথে সভা সেমিনারে যাচ্ছেন তিনি হক এবং বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী সালাফী মানহাজের উপর অবিচল যোগ্য ‘আলিম কিনা এবং বিদআতিদের সাথে দাওয়াতি মজলিসে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তার নিয়ত তথা উদ্দেশ্য কী?
.
বিদআতি আলেমদের সাথে দ্বীনি সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের বিদআত যদি কুফরি পর্যায়ের না হয় বরং আমলগত পর্যায়ের হয় এবং যিনি তাদের সাথে দাওয়াতী মাঠে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি যদি বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের আলেম তথা হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী এবং সালাফী মানহাজের উপর অবিচল ‘আলিম হোন আর তিনি তার নিজের ব্যাপারে আস্থাবান হোন যে তিনি হকের দলিল দিয়ে বাতিলকে আঘাত করতে পারবেন এবং তাদের বাতিল কর্ম থেকে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করার মাধ্যমে তাদের সংশয়গুলো বিশদভাবে বর্ণনা করতে পারবেন, সাথে তার উদ্দেশ্য যদি হয় বিদআতিদের মাঝে হকের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া তাহলে তার জন্য বিদ‘আতীদের সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করা জায়েজ বরং এটি কখনো কখনো ওয়াজিব। কেননা পাপাচারী, পথভ্রষ্ট, মূর্খ বিদ‘আতীর বিরুদ্ধে কথা বলা বর্জন করা এবং নীরব থাকা হকপন্থী ‘আলিমদের জন্য বৈধ নয় বরং এটি একটি মারাত্মক গলত কাজ। কেননা এটি অকল্যান ও বিদ‘আত প্রসারিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এটি কল্যাণ কমে যাওয়া, কল্যাণ দূরীভূত হওয়া এবং সুন্নাহ অপসৃত হওয়ারও অন্যতম কারণ। সুতরাং ‘আলিমদের জন্য হক বলা, এবং হকের দিকে লোকদের আহ্বান করা, বাতিলকে রদ করা এবং এ থেকে লোকদেরকে সতর্ক করা ওয়াজিব। তবে অবশ্যই তা হতে হবে শার‘ঈ ‘ইলম ও জাগ্রত জ্ঞান সহকারে।” ইতিহাস থেকে জানা যায় ইসলামের শাখাগত বিভিন্ন মাসআলা বিষয়ে আমাদের পূর্বসূরী ইমামগণ মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছেন।(আকীদাগত ও দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে মতবিরোধ ছিল খুবই সীমীত) তারপরও তাদের একে অপরের মাঝে বন্ধুত্ব বজায় ছিল। এর কারণ ছিল তারা দলীলকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ করেছেন। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিল সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত হওয়া। এখানে তাদের ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তবে যারা আকীগতভাবেই বিদআতী ছিল আমাদের পূর্বসূরীগণ তাদের সাথেও কথা বলেছেন, তাদের কাছে গেছেন এবং তাদের সাথে বির্তক করেছেন। এর কারণ ছিল তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা বা তাদের বাতিল আকীদাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেয়া যাতে অন্যরা সচেতন হয়। যেমন প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. খারেজী সম্প্রদায়ের সাথে বির্তক করেছেন, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বিভিন্ন বিদআতী গোষ্ঠির সাথে বির্তকে লিপ্ত হয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল যেন তারা সঠিক পথে ফিরে আসে বা অন্য মানুষ যেন তাদের মাধ্যমে প্রতারিত না হয়। বিদআতীদের সাথে এ ধরণের সম্পর্ক বর্তমানেও অব্যহত রাখা যাবে। তবে সাধারণ মানুষ নয় বরং যারা দ্বীনের বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং বাতিলের সাথে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখেন কেবল তারা। আর বিদআতীর বিদআতের প্রকার ও মাত্রার ভিত্তিতে তার সাথে আচরণও ভিন্ন ভিন্ন হবে। এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে- তাকে নসীহত করা, আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করা, তার সামনে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা, তার সন্দেহ-সংশয় দূর করা। এর পরেও সে যদি তার বিদআত চালিয়ে যেতে থাকে তাহলে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলে যদি সেটা ফলপ্রসু হয় তাহলে তার সম্পর্কচ্ছেদ করা আর এটি হবে তাদেরকে নসীহত এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার পর। কেননা এক একজন মুসলিমের উপর দায়িত্ব হল কোনো মুসলিম ভাইকে সঠিক পথ দেখানো এবং বিদআত বা স্পষ্ট হারাম কাজগুলো থেকে সতর্ক করা।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ولو سكت أهل الحق عن بيانه: لاستمر المخطئون على أخطائهم، وقلدهم غيرهم في ذلك، وباء الساكتون بإثم الكتمان الذي توعدهم الله في قوله سبحانه: إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَٰئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ ۚ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ. وقد أخذ الله على علماء أهل الكتاب الميثاق لتبيننه للناس ولا تكتمونه، وذمهم على نبذه وراء ظهورهم، وحذرنا من اتباعهم. فإذا سكت أهل السنة عن بيان أخطـاء من خالف الكتاب والسنة شَـابَهُوا بذلك أهل الكتاب المغضوب عليهم والضالين. “হকপন্থিরা যদি হক বর্ণনা করা থেকে চুপ থাকে, তাহলে ভুলকারীরা তাদের ভুলে অটল থাকবে এবং অন্যরা সেই ভুলের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করবে। আর নীরবতা অবলম্বনকারীরা শরিয়ত গোপনের পাপ বহন করবে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাদের হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। তবে তারা ছাড়া, যারা তাওবাহ করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব আমি তাদের তাওবাহ কবুল করব। বস্তুত আমি তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।”(সূরাহ বাক্বারাহ: ১৫৯-১৬০) আল্লাহ আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ‘আলিমদের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তারা তা মানুষের কাছে বর্ণনা করবে, গোপন করবে না। কিন্তু তারা সে অঙ্গীকার তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আল্লাহ তাদের ভর্ৎসনা করেছেন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করা থেকে সতর্ক করেছেন। কিতাব ও সুন্নাহ’র বিরোধীদের ভুল বর্ণনা করা থেকে আহলুস সুন্নাহ যদি চুপ থাকে, তাহলে তারা এর মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, যে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৭২-৭৩)
.
ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বিদআতিদের সাথে কিভাবে মেলামেশা করতে হবে সে সম্পর্কে বলেছেন,الواجِبُ هَجْرُهم على بِدعَتِهم إذا أظهروا البِدعةَ، فالواجِبُ هَجْرُهم بَعدَ النَّصيحةِ والتوجيهِ، فإنَّ المُسلِمَ يَنصَحُ أخاهُ، ويُحذِّرُهم مِمَّا حَرَّمَ اللَّهُ عليهم من البِدَعِ والمَعاصي الظَّاهِرةِ، فإن تاب وإلَّا استَحَقَّ أن يُهجَرَ ولا يُعامَلَ، لَعَلَّه يَتوبُ، لَعَلَّه يَندَمُ، لَعَلَّه يَرجِعُ إلى الصَّوابِ، إلَّا إذا كان الهجْرُ يَتَرَتَّبُ عليه ما لا تُحمَدُ عُقباهُ؛ فإنَّه يَترُكُه إذا كان تَركُه أصلَحَ في الدِّينِ، وأكثَرَ للخَيرِ وأقرَبَ إلى النَّجاحِ، فإنَّه لا يَهجُرُه بَل يُداوِمُ على نُصحِه وتَحذيرِه من الباطِلِ ولا يَهجُرُه، قد يَهديه اللَّهُ بسَبَبِ ذلك، فالمُؤمن كالطَّبيبِ إذا رَأى العِلاجَ نافِعًا فعلَهُ، وإذا رَآهُ لَيسَ بنافِعٍ تَركَه، فالهجْرُ من بابِ العِلاجِ، فإن كان الهجْرُ يُؤَثِّرُ خَيرًا ويَنفَعُ هَجَرَ، وكان ذلك من بابِ العِلاجِ، لَعَلَّهُ يَتوب ولَعَلَّهُ يَرجِعُ عنِ الخَطَأِ، إذا رَأى من إخوانِه أنَّهم يَهجرونَهُ، أمَّا إن كان الهَجْرُ يُسَبِّبُ مَزيدًا من الشَّرِّ، وكَثرةَ أهلِ الشَّرِّ وتَعاوُنَهم، فإنَّه لا يَهجُرُ، ولَكِن يُديمُ النُّصحَ لَهُ والتوجيهَ وإظهارَ الكَراهةِ لِما عَمِلَ، ويُبَيِّنُ لَهُ عَدَمَ موافَقَتِه على باطِلِه، ولَكِن يَستَمِرُّ في النَّصيحةِ والتوجيه) .
وقال ابنُ باز أيضًا: (المُؤْمِنُ يَنظُرُ في هذه المَقاماتِ بنَظَرِ الإيمانِ ونَظَرِ الشَّرعِ، ونَظَرِ التجَرُّدِ مِنَ الهوى، فإذا كان هجرُه للمُبتَدِعِ وبُعْدُهُ عنه لا يَتَرَتَّبُ عليه شَرٌّ أعظَمُ، فإنَّ هَجْرَهُ حَقٌّ، وأقَلُّ أحوالِه أن يَكونَ سُنَّةً، وهكَذا من أعلَنَ المَعاصيَ وأظهرَها، أقَلُّ أحوالِه أنَّ هَجْرَهُ سُنَّةٌ، فإن كان عَدَمُ الهَجْرِ أصلَحَ؛ لأنَّه يَرَى أنَّ دَعوةَ هؤلاء المُبتَدِعينَ وإرشادَهم إلى السُّنَّة، وتَعليمَهم ما أوجَبَ اللَّهُ عليهم، أنَّ ذلك يُؤَثِّرُ فيهم وأنَّه يُفيدُهم، فلا يَعْجَلُ في الهَجْرِ، ومَعَ ذلك يُبغِضُهم في اللَّهِ، كما يُبغِضُ الكافِرَ في اللَّهِ، ويُبغِضُ العُصاةَ في اللَّهِ، على قَدْرِ مَعاصيهم وعلى قدرِ البِدْعةِ، وبُغْضُ الكافِرِ أشَدُّ، وبُغْضُ المُبتَدِعِ على قَدْرِ بِدعَتِه إذا كانت بِدعَتُه غَيرَ مُكَفِّرةٍ، على قَدْرِها، وبُغْضُ العاصي على قَدْرِ مَعصيَتِه، ويُحِبُّه في اللهِ على قَدْرِ إسلامِه…
الحاصِلُ أنَّ الأرجَحَ والأَولَى النَّظَرُ في المَصلَحةِ، فالنَّبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم هجَرَ قَومًا وتَرَكَ آخَرين لم يَهجُرْهم، مُراعاةً للمِصلَحةِ الشَّرعيَّةِ الإسلاميَّةِ؛ فهجَر كعبَ بنَ مالِكٍ وصاحِبَيه رَضيَ اللهُ عنهم، لَمَّا تَخلَّفوا عن غَزوةِ تَبُوكَ بغَيرِ عُذرٍ، هَجرَهم خَمسِينَ لَيلةً، فتابوا فتابَ اللَّهُ عليهم ، ولم يَهجُرْ عَبدَ اللهِ بنَ أُبيٍّ بنَ سُلولَ، وجَماعةً من المُتَّهمِينَ بالنِّفاقِ؛ لأسبابٍ شَرعيَّةٍ اقتَضَت ذلك، فالمُؤمِنُ يَنظُرُ في الأصلَحِ، وهذا لا يُنافي بُغْضَ الكافِرِ في اللَّهِ، وبُغْضَ المُبتَدِعِ في اللَّهِ، وبُغْضَ العاصي في اللَّهِ، ومَحِبَّةَ المُسلِمِ في اللَّهِ. ومَحَبَّةُ العاصي على قدرِ إسلامِه، ومَحَبَّةُ المُبتَدِعِ الَّذي لم يُعلِنْ بِدعَتَه على قَدْرِ ما مَعَهُ من الإسلامِ؛ لا يُنافي ذلك، أمَّا هَجْرُهم فيُنظَرُ للمَصلَحةِ، فإذا كان هَجْرُهم يُرجَى فيه خَيرٌ لَهم، ويُرجَى أن يَتوبوا من البِدعةِ ومن المَعصيةِ، فإنَّ السُّنَّة الهَجْرُ، وقد أوجَبَ ذلك جَمعٌ من أهلِ العِلمِ، قالوا: يَجِبُ. وإن كان هَجْرُهم وتَركُه سَواءً لا يَتَرَتَّبُ عليه لا شَرٌّ ولا خَيرٌ، فهَجْرُهم أَولَى أيضًا، إظهارًا لأمرٍ مَشروعٍ، وإبانةً لِما يَجِبُ من إظهارِ إنكارِ المُنكَرِ، هَجْرُهُ بأيِّ حالٍ أَولَى وأسلَمُ، وحَتَّى يَعلمَ النَّاسُ خَطَأهم وغَلطَهم. الحالةُ الثَّالِثةُ: أن يَكونَ هَجْرُهم يَتَرَتَّبُ عليه مَفسَدةٌ وشَرٌّ أكبَرُ، فإنَّه لا يَهجُرُهم في هذه الحالةِ، إذا كان هذا المُبتَدِعُ إذا هُجِرَ زادَ شَرُّه على النَّاسِ وانطَلَقَ في الدَّعوةِ إلى البِدْعةِ، وزادَت بِدَعُه وشُرورُه، واستَغلَّ الهَجْرَ في دَعوةِ النَّاسِ إلى الباطِلِ، فإنَّه لا يُهجَرُ بَل يُناقَشُ ويُحذَّرُ النَّاسُ منه، ولا يَكونُ النَّاسُ عنه بَعيدِين، حَتَّى يُراقِبوا عَمَلَهُ وحَتَّى يَمنَعوهُ من التوَسُّعِ في بِدْعَتِه، وحَتَّى يُحَذِّروا النَّاسَ منه، وحَتَّى يُكَرِّروا عليه الدَّعوةَ؛ لَعَلَّ اللَّهَ يَهْديه حَتَّى يَسلَمَ النَّاسُ من شَرِّه) .
“যখন তাদের বিদআত স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখন তাদের বিদআতের কারণে তাদেরকে পরিত্যাগ করা আবশ্যক। তবে তাদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে নসীহত এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার পর। কেননা এক একজন মুসলিমের কর্তব্য হল অপর মুসলিম ভাইকে সঠিক পথ দেখানো এবং বিদআত কিংবা স্পষ্ট হারাম কাজগুলো থেকে সতর্ক করা। যদি সে তওবা করে, নচেৎ সে পরিত্যাগের যোগ্য, তার সাথে চলাফেরা পরিত্যাগ করতে হবে যাতে করে সে তওবা করে, অনুতপ্ত হয় এবং সঠিক পথে ফিরে আসে। তাকে পরিত্যাগ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সে যেন দ্বীনে ফিরে আসে এবং যা তার জন্য অধিক কল্যাণকর হয়, নাজাতের নিকটবর্তী হয়। পক্ষান্তরে যদি তাকে পরিত্যাগ না করেন বরং উপদেশ দিতেই থাকেন তাহলে হয়তো সে পাপ/বিদআতকে পরিত্যাগ করবে না। সুতরাং তাকে পরিত্যাগ করাই উচিত তাতে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তাকে সঠিক পথ দেখাবেন। কারণ মুমিন ব্যক্তি হলো একজন ডাক্তারের মত। ডাক্তার যেমন কোন রোগীর অসুখকে দেখে যদি মনে করেন যে ভালো হবে তাহলে তিনি কাজ শুরু করেন আর যদি রোগীর অসুখ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নাই তাহলে ডাক্তার সেই রোগীকে ছেড়ে দেয়। আর বিদআতি ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করাটা অসুস্থতার মতোই। বিদআতী ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করার ফলে যদি তার কল্যাণ হয়, উপকার হয়, তাহলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে হয়তো সে তওবা করে তার ভুল থেকে সঠিকের দিকে ফিরে আসবে। আর যদি দেখা যায় যে তাকে পরিত্যাগ করার ফলে সে ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই বরং তার পাপ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে তাহলে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে না বরং তাকে সর্বদা উপদেশ দিতে হবে সঠিকটা বুঝাতে হবে। তাকে স্পষ্ট করে বুঝাতে হবে যে বাতিল কখনোই শরীয়ত সম্মত নয়। এমন নাসিহা এবং সঠিক পথের উপদেশ তার প্রতি চলমান থাকবে।
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ)আরো বলেন,”একজন মুমিন ব্যক্তি প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বের হয়ে ঈমান ও শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করবে, ফলে বিদাতিদেরকে পরিত্যাগ করা এবং তাদের থেকে দূরে থাকার ফলে যদি বড় কোন অনিষ্ঠতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে তাকে পরিত্যাগ করা যথেষ্ট হবে। তবে এরকম পরিস্থিতিতে খুব কমই তা সুন্নাত হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি তার অন্যায় পাপ গুলো প্রচার ও প্রকাশ করবে, তখন এ সময় তাকে পরিত্যাগ করা খুব কমই সুন্নত হিসেবে পরিগণিত হয়, যখন পরিত্যাগ না করাতে বেশি কল্যাণ নিহিত থাকে। কারন সে মনে করে যে এ সকল বিদাআতিদেরকে দাওয়াত দেওয়া এবং তাদেরকে সুন্নাহর দিকে পথ দেখানো এবং আল্লাহ তাদের উপর যা ওয়াজিব করেছেন সেগুলো শিক্ষা দেওয়ার মাঝে তাদের জন্য প্রভাব ফেলবে এবং তাদের কিছুটা হলেও উপকার হবে। তাহলে তাদেরকে পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা যাবে না। তবে এর পরেও বিদআতিদের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে শত্রুতাপোষন করবে। যেমন ভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাফেরদের সাথে শত্রুতা করে এবং পাপীদের সাথে আল্লাহর উদ্দেশ্যে শত্রুতা করে। পাপীকে তার পাপ সমপরিমাণ ঘৃণা করবে। আর কাফেরকে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা করবে, একজন বিদআতি ব্যক্তিকে তার বিদআত অনুযায়ী ঘৃণা করবে। যখন তার বিদআত কুফরী হবে না। আর তাকে আল্লাহর জন্য তার ভালো কাজের পরিমাণ অনুসারে ভালবাসবে। মূল কথা হলো মাসলাহাতের দিকে লক্ষ্য করে সবকিছু করা উচিত। নবী (ﷺ) এক জাতিকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং অন্য জাতিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু তাদেরকে পরিত্যাগ করেননি তাদের ইসলামী শরীয়তের মাসলাহাতের দিকে লক্ষ্য করে। রাসূল ﷺ কাব ইবনে মালেককে ও তাঁর দুজন সাহাবীকে পরিত্যাগ করেছিলেন যখন তারা তাবুক যুদ্ধে কোন ওজর ছাড়াই অংশগ্রহণ করেনি তখন রাসূল ﷺ তাদের সাথে পঞ্চাশ রাত্রি সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন তারপরে তারা তওবা করেছিল আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া কবুল করেছেন। আবার শরীয়তের কল্যানের স্বার্থে আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সালুল এবং মুনাফিকের অভিযুক্ত একটি দলকে পরিত্যাগ করেননি; মুমিন সব সময় সংশোধনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাই বলে এটি কাফেরকে ঘৃণা না করার দলিল নয়।মোটকথা তাদের পরিত্যাগ করতে হবে মাসলাহাতের দিকে লক্ষ্য করে যখন তাদের পরিত্যাগ করার মাঝে কল্যাণ থাকবে বা বিদআত থেকে তাওবা করার আশা থাকবে। যদি দেখা যায় তাদের পরিত্যাগ করার মাধ্যমে কোন কল্যাণও নাই কোন ক্ষতিও নাই তাহলে তাদের পরিত্যাগ করাই উত্তম। যদি পরিত্যাগ করাটা তার ক্ষতি বৃদ্ধি করে তাহলে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে না যখন বিদআতকারীকে পরিত্যাগ করবে তখন মানুষের কাছে তার খারাপটা বৃদ্ধি পাবে এবং সে তার বিদআতের দিকে দাওয়াত দিবে এবং তার বিদআত ও অনিষ্ঠতা বাড়তে থাকবে আর সে মানুষদেরকে বাতিলের দিকে দাওয়াত দেওয়াতে আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে ফলে তাকে পরিত্যাগ না করে তার থেকে মানুষকে সতর্ক করতে হবে এবং মানুষেরা যেন তার থেকে অনেক দূরে থাকে, তার আমল সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। যাতে করে সে তার বিদআতমূলক কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে প্রচার না করতে পারে আর তাকে বারবার বিশুদ্ধ শরীয়তের পথে দাওয়াত দিতে হবে ,আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা চাইলে তাকে পথ দেখাতে পারেন এবং মানুষদেরকে তারা অনিষ্ঠ থেকে নিরাপদ করবেন।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৪২৩-৪২৪)
..
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,
(هِجرانُ أهلِ البِدَعِ.الهِجرانُ: مَصدَرُ هجَرَ، وهو لُغةً: التركُ، والمُرادُ بهِجرانِ أهلِ البِدَعِ الابتِعادُ عنهم، وتَرْكُ مَحَبَّتِهم وموالاتِهم والسَّلامِ عليهم وزيارَتِهم وعيادَتِهم ونَحوِ ذلك.
وهِجرانُ أهلِ البِدَعِ واجِبٌ؛ لقَولِه تعالى: لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ [المُجادَلة: 22] .
ولِأنَّ النَّبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم هجَرَ كعبَ بنَ مالِكٍ وصاحِبَيه حينَ تَخَلَّفوا عن غَزوةِ تَبوك .لَكِن إن كان في مُجالَسَتِهم مَصلَحةٌ لتَبيينِ الحَقِّ لَهم وتَحذيرِهم من البِدعةِ، فلا بَأسَ بذلك، ورُبَّما يَكونُ ذلك مَطلوبًا؛ لقَولِه تعالى: ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ [النحل: 125] ، وهذا قد يَكونُ بالمُجالَسةِ والمُشافَهةِ، وقد يَكونُ بالمُراسَلةِ والمُكاتَبةِ
“বিদআতিদের পরিত্যাগ করা :هِجرانُ ( হিজরান) শব্দটি هجَرَ ( হাজারা) এর মাসদার অর্থাৎ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু। যার আভিধানিক অর্থ হলো পরিত্যাগ করা। হিজরান দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিদআতিদেরকে পরিত্যাগ করা, তাদের থেকে দূরে থাকা তাদের ভালোবাসা, মেলামেশা, সালাম, সাক্ষাৎ ইত্যাদি পরিত্যাগ করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন,”আপনি পাবেননা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে”।(সূরা মুযাদালা: ২) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’ব ইবনু মালেককে এবং তাবুক যুদ্ধে যারা পিছনে পড়েছিল তাদের দুইজনকে পরিত্যাগ করেছিলেন। তবে তাদের নিকটে সত্যকে স্পষ্ট করার জন্য এবং বিদআত থেকে সতর্ক করার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ বৈঠক করাতে কোন সমস্যা নেই। কেননা তাদের নিকটে সত্যকে স্পষ্ট করাই হলো মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন,”আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়”।(সূরা নাহল: ১২৫) আর এটা হতে পারে পরামর্শ বৈঠকের মাধ্যমে, মুখোমুখি ভাবে, মেসেজের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে ইত্যাদি।…..(ইবনু ‘উসাইমীন, শারহু লুম‘আতিল ই‘তিক্বাদ; পৃষ্ঠা: ১১১)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, “বিদআতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১). কুফুরী বিদআত (২). কুফরী বিদআত নয়। আমাদের জন্য আবশ্যক হলো এই দুই প্রকার লোকদেরকে এবং যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা। তাদের সাথে যারা কুফরী বিদআতি এবং যারা কুফরি বিদআতি নয় তাদেরকে সত্যের দিকে আহবান করা। তাদের উপর যে ধারণা করা হয় তার ওপর আক্রমণ করা ছাড়াই সত্য বর্ণনার মাধ্যমে। ফলে আমরা জানতে পারবো তাদের মধ্যে যারা সত্য গ্রহণে অহংকার করে তাদের সম্পর্কে। কারণ আল্লাহ তাআলা রাসূল (ﷺ) কে বলেন,”আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত।(সূরা আনআম: ১০৮) তাই প্রথমত আমরা সত্যের দিকে আহবান করব, সত্য বর্ণনা এবং সুস্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে। আর প্রত্যেক সুস্থ বিবেকবান ব্যক্তির নিকটে সত্যই গ্রহণযোগ্য। যখনই তাদের মাঝে একগুয়েমি ও অহংকার পাওয়া যাবে আমরা তাদের ভ্রান্ত বিষয়কে স্পষ্ট করে দিব। আর তাদের সাথে কোন বিতর্ক করা ছাড়াই তাদের ভ্রান্ত বিষয় স্পষ্ট করা একটি ওয়াজিব বিষয়। আর তাদের পরিত্যাগ করাটা হবে তাদের বিদআতের শ্রেণী বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে। যদি তাদের বিদআতটা হয় কুফরী তাহলে তাদের পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। আর যদি তাদের বিদআতটা কুফুরি না হয় তাহলে আমরা তাদের পরিত্যাগ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকবো যদি তাদের পরিত্যাগ করাতে কল্যাণ থাকে তাহলে আমরা তাই করবো। আর যদি তাদের পরিত্যাগ করার মধ্যে কোন কল্যাণ না থাকে তাহলে আমরা এড়িয়ে চলবো। কেননা আসল কথা হলো মুমিনের (অপর ভাইকে) পরিত্যাগ করাটা হলো হারাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,”কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য উচিত নয় তার ভাইকে তিন দিনের বেশি পরিত্যাগ করে রাখা”। প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি যদিও সে ফাসেক হয় এবং তাকে বর্জন করার মাঝে যদি কোন কল্যান না থাকে তাহলে তাকে বর্জন করা হারাম, যদি বর্জন করাতে কোন কল্যাণ থাকে তাহলে আমরা তাকে বর্জন করব। কেননা এমতাবস্থায় পরিত্যাগ করাটাই হলো প্রতিকার। আর যদি তাতে কোন কল্যাণ না থাকে অথবা তাতে সীমালংঘন এবং অবাধ্যতা বৃদ্ধি পায় তাহলে তাকে বর্জন করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। আর এটাই হল কল্যাণ। যদি কোন প্রশ্নকারী বলেন: নবী কারীম( সা) বর্ণনা করেছেন যে কা’ব ইবনে মালেক এবং তার দুজন সাথীদেরকে পরিত্যাগ করেছিলেন যারা তাবুকের যুদ্ধে পিছু হটেগেছিল। তাহলে তাদের জন্য উত্তর হল: আর এটা নবী করীম (ﷺ) বর্ণনা করেছেন এবং তিনি সাহাবীদেরকে তাদের পরিত্যাগ করার ব্যাপারে আদেশ করেছেন যাতে করে তাদের পরিত্যাগ করাতে মহান সম্মানিত হয়। আর যারা বিরত থেকেছে এমনকি কা’ব ইবনে মালিক (রা:) গাস্সানের বাদশার একটি চিঠি হাতে পান চিঠিতে বাদশা লিখেন: আমি জানতে পেরেছি যে, আপনার নেতা (রাসূল ﷺ) আপনার উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। অথচ আল্লাহ্ আপনাকে লাঞ্জনা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখেন নি। আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন। আমরা আপনাকে মর্যাদা ও আরামের সাথে রাখবো। কা’ব তার এত কঠিন মুহূর্ত অসন্তীর্ণতার মাঝেও তার সাথে থাকা চিঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং চিঠিটি নিয়ে গেলেন এবং চুলায় পুড়িয়ে ফেললেন। এ সমস্ত লোকেরা তাদের পরিত্যাগের ক্ষেত্রে একটি বড় উপকার অর্জিত হয়েছিল। অতঃপর ওই ফলাফল যেটা সমান হতে পারে না যে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর কোরআন নাজিল করেছিলেন যে কোরআন কেয়ামত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,”আল্লাহ অবশ্যই নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করলেন, যারা তার অনুসরণ করেছিল সংকটময় মুহুর্তে- তাদের এক দলের হৃদয় সত্যচ্যুত হওয়ার উপক্রম হবার পর। তারপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করলেন; নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি অতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু। আর তিনি তাওবা কবুল করলেন অন্য তিনজনেরও, যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল, যে পর্যন্ত না যমীন বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সেটা সংকুচিত হয়েছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়েছিল আর তারা নিশ্চিত উপলব্ধি করেছিল যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য তিনি ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। তারপর তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করলেন যাতে তারা তাওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।(সুরা তওবাহ: ১১৭, ১১৮ উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১১তম খণ্ড)
..
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ (মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: “বিদাতিদের দারসে উপস্থিত হওয়ার বিধান কী?” উত্তরে শাইখ বলেন,
: إذا كان يحضر دروس أهل البدعة من أجل أن يناقشهم ويبين لهم الحق والصواب فهو واجب. وإذا كان يريد أن يتعلم منهم فلا يتعلم منهم، حتى لو كان في غير العقيدة، حتى لو كان يدرسهم في النحو أو البلاغة. لا تـقـربهم؛ لأنهـم قد يدسون السم في الدسم، وأيضاً إذا حضرتهم ربما يغتر بك أحد من الناس؛ يقول هؤلاء ليس في حضور دروسهم بأس.
“কোন ব্যক্তি যদি বিদআতিদের সাথে (ইলমি) বিতর্ক করার জন্য এবং তাদের কাছে হক ও সঠিক বিষয় তুলে ধরার জন্য তাদের দারসে উপস্থিত হয়, তবে তা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে কেউ যদি তাদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করতে চায়, তবে সে যেন তাদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন না করে। যদিও তা আকিদাহ ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের জ্ঞান হয়; যদিও সে তাদের কাছে নাহু (আরবি ব্যাকরণশাস্ত্র) ও বালাগাত (অলংকারশাস্ত্র) অধ্যয়ন করে। তুমি তাদের নিকটবর্তী হবে না। কেননা তারা তেলের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেয় (অর্থাৎ ক্ষতিকর বিষয় আকর্ষণীয় মোড়কে উপস্থাপন করে)। অনুরূপভাবে তুমি যখন তাদের কাছে উপস্থিত হবে, তখন হয়তো তোমার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ধোঁকায় পতিত হবে। ফলে বলবে, তাদের দারসে উপস্থিত হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।”(ইমাম ইবনু উসাইমিন, লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ; ১৬২ নং অডিয়ো ক্লিপ)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ)-কে প্রশ্নকারী: কিছু মানুষ বিদ’আতী বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী দলের সাথে উঠা-বসা করে। এভাবে তারা তাদের সাথে দীর্ঘ বছর কাটিয়ে দেয়। তাদেরকে যখন বলা হয় তোমরা তাদের সাথে উঠা-বসা করো না। তখন তারা বলে, এটি একটি দাওয়াত দেওয়ার উপকরণ। যাতে করে তাদেরকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারি। এ ধরনের কাজের হুকুম কী? তিনি উত্তরে বলেন:”যদি কোন ব্যক্তি আলেম হয় এবং বিদ’আতীদের সাথে উঠা-বসা করার মাঝে কল্যাণ নিহিত থাকে; যে সে তাদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবে, তাহলে এটি দু-টি শর্তসাপেক্ষে করা যাবে। (১). এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ইলম থাকতে হবে। (২). তাদের সাথে বসে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়ে তাদের মাঝে প্রভাব ফেলতে হবে। কারণ এটিই আল্লাহর পথে দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য।আর যদি এ বিষয়ে (ইলম) জ্ঞান না থাকে এবং তাদের (বিদআতিদের) মাঝে প্রভাবের কোনো আশঙ্কা না থাকে তাহলে তাদের সাথে উঠা বসা করা যাবেনা। কেননা তারা কখনো সত্যকে চায় না।ফলে তাদের সাথে বসেও লাভ নাই। (দেখুন: https://youtube.com/watch?v=695V4fYeaSg&si=TbUdzCyEUSWl5N2W
., .
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-‘আল্লামাহ, আল-ফাক্বীহ, ইমাম রাবী‘ বিন হাদী আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.]- বিদআতি ও দলবাজদের সাথে উঠা বসার সুন্দর একটি নীতি উল্লেখ করে শাইখ বলেন,
الآن السلفيون قسمان :ـ سلفي قوي ، يستطيع أن يبلغ دعوة الله في أهل البدع وفي الأحزاب ـ بارك الله فيك ـ بالحجة والبرهان ، ويؤثر فيهم ولا يؤثرون فيه ، فهذا واجبه أن يختلط بهؤلاء ويدعوهم ، لا لأجل أكل ولأجل شرب ولا مداهنة ولا شيء ولا إقرارعلى باطل ، إنما يحصلهم في المساجد يدعوهم ، يحصلهم في الأسواق يدعوهم ، يركب معاه في سيارة يدعوه ، يركب معاه في طائرة يدعوه ، يركب في قطار يدعوه ، بارك الله فيك ـ يدعو لأنه لابد من الإختلاط بهؤلاء ـ ما له فكة منهم ـ لأن أهل البدع والأهواء أغلبية ساحقة وأن السلفيين كالشعرة البيضاء في الثور الأسود ـ بارك الله فيكم ـ فرغم أنفه يختلط بهؤلاء ، لكن أيش واجبه ـ واجبه ـ تبليغ دعوة الله بالحكمة والموعظة الحسنة ،
إنسان جاهل ضعيف الشخصية إذا سمع أدنى شبهة أخذته ، أو شُبه ، هذا ينبغي أن ينجو منهم ويبتعد عنهم لا يجالسهم ، لكن إذا امتحنك إنسان وسلم عليك قل وعليك السلام ، بارك الله فيك ، لكن تجالسهم وتُآكلهم تضاحكهم تجلس إليهم أنت مخالف للمنهج السلفي ومخالف للسنة ، وذاك الذي يستطيع أن يؤثر فيهم ويبلغهم دعوة الله ثم يجلس في بيته بحجة هجران أهل البدع ! هذا موَّت الدعوة ـ عرفتم ـ يعني ـ الآن أنا ربيع ، خلاص لا أرى مبتدع إلا وأ فر منه ، وما أدري فلان وفلان وفلان وفلان من طلاب العلم لا يرى مبتدع إلا و فر ، شافه ـ طل بوجهه كِذا من أمام البيت ، شاف مبتدع دس نفسه ، شافه في شارع هرب من شارع ثاني ، هذا ليس طريقا سلفيا ، الصحابة كانوا ينتشرون في الكفار في أقطار الأرض وينشرون دين الله فيهم بارك الله فيكم ، السلفيون اللي قبلنا انتشروا في أهل البدع وأثروا فيهم وأدخلوا الملايين في حظيرة المنهج السلفي ، فمن كان مناظرا قويا وقوي الشخصية وعالم يقيم الحجة يدعو هؤلاء بالحكمة والموعظة الحسنة وسترون آثار هذا ، والضعيف لا والله لا يخالط ، في الجملة ، لكن إذا امتُحن بالسلام عليه فليسم ما فيه شيء ، ماذا يصنع ؟ بارك الله فيكم ، نعم .لكن لا يخالط ولا يجالس .
সালাফিরা দুই প্রকার:
*(১). একজন শক্তিশালী সালাফী: তিনি বিদআতী এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারেন যুক্তি ও প্রমাণ সহ, (আল্লাহ আপনার মাঝে বরকত দান করুন) সে তাদের প্রভাবিত করতে পারেন, তারা তাকে প্রভাবিত করতে পারে না, এমন সালাফীর ওপর কর্তব্য হবে এই লোকদের সাথে মেশা ও তাদেরকে দাওয়াত দেয়া। তবে তাদের দাওয়াত খাওয়ার জন্য বা চাটুকারিতা করার জন্য বা দীনের অন্য কোনো কারণে বা তাদের কাছে থাকা কোনো বাতিলের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য নয়। কর্তব্য হবে মসজিদে তাদের দাওয়াত দেয়া, বাজারে তাদের সাথে দেখা করে দাওয়াত দেয়া, তাদের গাড়িতে চড়ে দাওয়াত দেয়া, তাদের সাথে প্লেনে চড়ে দাওয়াত দেয়া, তাদের সাথে ট্রেনে চড়ে তাদেরকে দাওয়াত দেয়া। তাদেরকে দাওয়াত দিতে হলে তাদের সাথে মিশতে হবে – তাদের কাছ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ নেই। কারণ বিদআতী ও প্রবৃত্তিপূজারীদের সংখ্যাই তো বেশি, এর বিপরীতে সালাফিরা একটি কালো ষাঁড়ের সাদা চুলের মতো (আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন) তাই তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে এসব মানুষের সাথে মিশতে হয়। এমতাবস্থায় তার কর্তব্য কী? তার কর্তব্য হল প্রজ্ঞা এবং সুন্দর উপদেশের সাথে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানো। এখন যদি সে “বিদআতী ত্যাগ করা” এ নীতির অজুহাতে ঘরে বসে থাকে, তাহলে তো সে দাওয়াতকেই মেরে ফেলল!!
*(২). অপরজন দুর্বল সালাফী: দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অজ্ঞ ব্যক্তি, যদি সামান্যতম সন্দেহের কথাও শোনে সেটা গ্রহণ করে ফেলে। এমন সালাফীর উপর কর্তব্য হবে, সে যেন সন্দেহবাদী ও বিদআতী লোকদের থেকে দূরে থাকে এবং তাদের সাথে না বসে। তবে যদি কেউ তাকে বিপদে ফেলতে সালাম দেয়, তার জবাবে সে যেন বলে, ওয়াআলাইকুমুস সালাম। কিন্তু এ অবস্থায় সে তাদের সাথে বসলে, তাদের সাথে খেলে, তাদের হাসাতে যুক্ত হলে এবং তাদের সঙ্গ দিলে তা হবে মারাত্মক ভুল করা; কারণ এমন কাজ করলে তা হবে সালাফী মানহাজের পরিপন্থী এবং সুন্নাহ বিরোধী কাজ… আমাদের পূর্বের সালাফীরাও বিদআতী লোকদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করেছিলেন, তাদের প্রভাবিত করেছিলেন এবং হাজার হাজার লোককে সালাফী পন্থার মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। সুতরাং যে কেউ হবে শক্তিশালী বিতর্ককারী, শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বা দীনের আলেম, তার ওপর কর্তব্য হবে, প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা, লোকদেরকে প্রজ্ঞা ও সুন্দর প্রচারের সাথে আহ্বান করা। আপনি এর প্রভাব অবশ্যই দেখতে পাবেন।কিন্তু যদি (সালাফী ব্যক্তি) হয় দুর্বল: তবে আল্লাহর শপথ সে বিদআতীদের সাথে মিশবে না। যদি তাকে সালাম দিতে বাধ্য করা হয় তবে সে যেন তাকে সালাম দেয়। এতে তার মধ্যে দোষের কিছু নেই, নইলে তার আর কী বা করার আছে? কিন্তু সে যেন ইচ্ছা করে তাদের সাথে না মিশে বা তাদের সাথে না বসে”।(মাজমূআতু কুতুব ওয়া রাসায়িলিশ খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৮৮-৪৯০)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, যাদের বিদআত কুফরি পর্যায়ের নয় তাদেরকে নসীহত (সদুপদেশ) করা এবং তার বিদআতের প্রতিবাদ করা, তাদের হকের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদআতীদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া এবং তাদের দাওয়াতি মজলিস, সভা সেমিনার ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা যাবে। বরং কখনো কখনো এটি করা অপরিহার্য।পক্ষান্তরে যাদের বিদআত কুফরি পর্যায়ের যেমন (খারেজী, রাফেযী, ক্বাদারিয়া ও জাহমিয়াদের বিদআত) তাদেরকে কাফেরদের ন্যায় ব্যক্তিগতভাবে হকের পক্ষে নসিহা, উপদেশ দেওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সাথে মেলামেশা করা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা তাদের সাথে কোন রকমের দ্বীনি মজলিস, সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করা যাবে না। আমাদের সালাফগণ এদেরকেই বর্জন করেছেন। কারণ এতে করে তাদের সাথে মেলাজন্য মেশাকারীদের মধ্যে খারাপ আকীদা ও আমলগুলোর প্রভাব পড়তে পারে এবং অন্যদের মাঝেও তাদের বিদআত প্রবেশ করতে পারে। এবং অনেক সালাফী মানহাজ অনুসারী তাদের কার্যক্রম সালাফী মানহাজ মনে করে সেদিকে ধাবিত হবে।ইতিহাসের বহু প্রমাণ রয়েছে যেমন: ইমাম ইয়া‘কূব বিন শাইবাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৬২ হি.] বলেছেন,বানূ সাদওয়াস গোত্রে ‘ইমরান বিন হিত্বত্বান নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে নাবী ﷺ এর একদল সাহাবীকে পেয়েছিল। এতৎসত্ত্বেও সে খারিজী মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিল। এর কারণ সম্পর্কে আমাদের কাছে যে সংবাদ পৌঁছেছে তা হলো, তার এক চাচাতো বোন ছিল, যে খারিজী মতাদর্শ লালন করত। ‘ইমরান সেই মেয়েকে বিয়ে করে, তাকে তার ভ্রান্ত মতাদর্শ থেকে ফেরানোর জন্য। কিন্তু ওই মেয়েই তাকে নিজের মতাদর্শে দীক্ষিত করে ফেলে।”(তারীখু দিমাশক্ব; খণ্ড: ৪৩; পৃষ্ঠা: ৪৯০; তাহযীবুল কামাল; খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ৩২৩) পরবর্তীতে এই খারিজী ‘ইমরান বিন হিত্বত্বান ইসলামের চতুর্থ খলিফা ‘আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র হত্যাকারী ‘আব্দুর রহমান বিন মুলজিম আল-খারিজী’র প্রশংসা করে দীর্ঘ কবিতা রচনা করে। আল্লাহ’র কাছে যাবতীয় বিদ‘আত ও তার বাহকদের সংস্পর্শ থেকে পানাহ চাচ্ছি। আমরা আল্লাহর কাছে আরো প্রার্থনা করি, তিনি যেন তার দীনকে বিজয়ী করেন এবং তার শত্রুদেরকে অপমানিত করেন। আমরা আমাদের জন্য ও তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে সিরাতুল মুস্তাকীমের হেদায়েত লাভের প্রার্থনা করছি। নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শুহাদাগণ ও সালেহীনগণের পথ আল্লাহ্ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আরও প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের পথ থেকে দূরে রাখেন যাদের প্রতি তিনি রাগান্বিত হয়েছেন কিংবা তাদের পথও নয় যারা পথভ্রষ্ট। নিশ্চয় তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান।