প্রশ্ন: ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল ইত্যাদি খেলাধুলা করা এবং দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উত্তর: খেলা-ধুলা মানুষের জন্মগত স্বভাব। এর উদ্দেশ্য সাময়িক শরীর চর্চা। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বয়স ভেদে মানুষের শরীর চর্চার ধরনের পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাময়িক শরীর চর্চার বদলে যদি তা কেবল সময়ের অপচয় হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, যদি ঐ ব্যক্তি দ্বীন থেকে গাফেল হয়, দায়িত্ব বিস্মৃত হয় বা তাতে জুয়া মিশ্রিত হয়, তখন ঐ খেলা হারামে পরিণত হয়।খেলাধুলা দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান হলো যে সকল খেলাধুলায় সরাসরি জুয়া নেই হারাম, কোন কর্মকান্ড নেই এবং শারীরিক ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে করা হয় সে সকল খেলাধুলা করা যেমন জায়েজ রয়েছে তেমনি শরীয়তের বিধি বিধান মেনে চাইলে সেগুলো দেখা যেতে পারে মোটকথা যে সকল খেলাধুলার সাথে কোন প্রকার হারাম কাজ যেমন:
- জুয়া বা বাজি ধরা
- আওড়াহ প্রকাশ করা,
- নারী-পুরুষ ফ্রী মিক্সিং,
- গান-বাজনা ইত্যাদি জড়িত না থাকে, তাহলে এমন খেলায় অংশগ্রহণ করতে বা এই খেলাগুলো দেখতে কোন সমস্যা নেই ইন শাহ্ আল্লাহ।
নিশ্চয়ই একমাত্র আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। [সৌদি আরবের সর্বচ্ছো ফাতওয়া বোর্ড-ফাতওয়া আল-লাজনাহ আদ-দাই’য়িমাহঃ ১৫/২৩৮। স্থায়ী ফাতওয়া কমিটির ফাতওয়া নং– ১৮৯৫১]।
.
মোটকথা ইসলাম শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল ইত্যাদি খেলাধুলা করা এবং দেখা জায়েয। ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন প্রত্যেক খেলা-ধুলা, যা শারীরিকভাবে কোন ক্ষতিসাধন করে না এবং ধর্মীয় কাজেও কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না,তা বৈধ।’ (আল-মুগনী, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭)। তবে এই অনুমতি শুধু সাময়িক বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কেউ খেলা-ধুলাকেই বা বিনোদনকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয় এবং এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে,তখন তা হালাল বা বৈধ থেকে হারাম বা মাকরূহের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
.
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَكُلُّ شَيْءٍ يَلْهُوْ بِهِ الرَّجُلُ بَاطِلٌ إِلَّا رَمْيَهُ بِقَوْسِهِ وَتَأْدِيْبَهُ فَرَسَهُ وَمُلَاعَبَتَهُ امْرَأَتَهُ. ‘এমন প্রত্যেক জিনিস যা মানুষকে উদাসীন ও দ্বীন বিমুখ করে তোলে, তা পরিত্যাজ্য। শুধু তীরন্দাজী করা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং নিজ স্ত্রীর সাথে প্রেম বিনিময় করা ব্যতীত।’ (দারিমী, হা/২৪৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩০০,১৭৩৩৭) শুআইব আল-আরনাঊত্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সমস্ত তথ্য ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের)। ইমাম শাত্বিবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন খেলা-ধুলা, যা নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং নিষিদ্ধকরণের কোন কারণও সংগঠিত হয়নি, তা মুবাহ বা অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু এটি নিন্দিত কাজ। আলেমগণ এর উপর সন্তুষ্ট নন। বরং তাঁরা এটা অপছন্দ করেন যে কোন একজন ব্যক্তি সামাজিক ও মানবিক সংস্কারমূলক কাজে নিয়োজিত না হয়ে, তার মূল্যবান সময় এমন একটি কাজে ব্যয় করে, যার মধ্যে ইহকাল ও পরকালের জন্য কোন কল্যাণ নেই।’ (আল-মুওয়াফাক্বাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৪-২০৫)।
.
ইসলাম শর্তসাপেক্ষে কিছু খেলাকে জায়েয করেছে। শর্তগুলো হল:
(১) ইসলামের ফরয ইবাদত পালন থেকে উদাসীন না হওয়া। যেমন: কোন ফরয সালাত ও সালাতের জামা‘আতের সময় খেলাধুলা করা।(সূরা লুক্বমান: ৬; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)।
(২) শরী‘আতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রাখা (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)। সুতরাং খেলাটি হতে হবে ইসলামের জন্য জিহাদের প্রস্তুতি,শারীরিক সক্ষমতা অর্জন ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে।
(৩) সর্বদা সতর আবৃত রাখা (আবু দাঊদ, হা/৪০১৭; তিরমিযী, হা/২৭৯৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭০৬; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)।
(৪) জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৯৫)।
(৫) জুয়া বা হারাম মিশ্রিত না হওয়া (সূরা আল-মায়িদাহ: ৯০)।
(৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া। (সূরা আল-মায়িদাহ: ৯১; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)। যদি উক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি পাওয়া যায়, তখন সে খেলা হারাম হবে।
.
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেনঃ একদা আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আমার ঘরের দরজায় দেখলাম। তখন হাবশার লোকেরা মসজিদে (বর্শা দ্বারা) খেলা করছিল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখছিলেন। আমি ওদের খেলা অবলোকন করছিলাম।(আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৪১, সহিহ বুখারী: হাদিস নং ৪৫৪)।
আর ইসলাম অনুমতি দিয়েছে পুরষ্কার নেওয়ার এমন খেলা হচ্ছে:
- ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা
- উটের দৌড় প্রতিযোগিতা
- তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা।যেমন: আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তীর নিক্ষেপ এবং উট ও ঘোড়দৌড় ব্যতীত অন্য কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই। [সহীহ্, ইবনু মা-জাহ ২৮৭৮ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৭০০]।
.
উল্লেখ্য যে, বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট সহ প্রচলিত অধিকাংশ খেলাধুলায় ইসলামী শরী‘আতের উপরিউক্ত শর্তাবলী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং জীবনের ঝুঁকি, সালাতের প্রতি অবহেলা, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজিধরা, রঙখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কী আঁকা ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে, যা শরী‘আতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।
.
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘এমন ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ যেগুলো অর্থ অথবা পুরস্কারের জন্য খেলা হয়ে থাকে, সেগুলো হারাম। এগুলো হারাম জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। কারণ শরী‘আত অনুমোদিত খেলা ছাড়া অন্য যেকোন খেলার জন্য বিনিময় বা পুরস্কার গ্রহণ করা নাজায়েয। আর ইসলাম অনুমোদিত খেলাগুলো হচ্ছে ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা, উটের দৌড় প্রতিযোগিতা এবং তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। সুতরাং জেনেশুনে এ ধরনের পুরস্কার গ্রহণের খেলার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা এবং দেখা উভয়ই হারাম। কেননা এ ধরনের খেলায় উপস্থিত হওয়াটা তাকে সমর্থন করার শামিল।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২৩৮, ফৎওয়া নং-১৮৯৫১)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, এগুলো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সংকীর্ণ পোশাক পরিধান করে অথবা উরু উন্মুক্ত করে খেলাধুলা করা জায়েয নয়। অতএব তা দেখাও নাজায়েয। অতঃপর তিনি দলীল হিসাবে নিম্নের হাদীসটি উপস্থাপন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,‘ক্বিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ তা‘আলার নিকট হতে সরতে পারবে না।
(১) তার আয়ুস্কাল সম্পর্কে,সে তার জীবনকাল কোথায় অতিবাহিত করেছে?
(২) তার যৌবনকাল সম্পর্কে,কী কাজে তা বিনাশ করেছে?
(৩) ও (৪) তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথায় হতে তা উপার্জন করেছে এবং কোন কোন খাতে তা খরচ করেছে? এবং
(৫) সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মুতাবেক কী কী আমল করেছে’? (তিরমিযী, হা/২৪১৬; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৪৬; ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৩১)।
.
পরিশেষে, আমরা যারা আল্লাহকে ভয় করি, আখিরাতের ফিকির করি, আল্লাহর সামনে হাজির হওয়ার উপর ঈমান রাখি আমাদেরকে অবশ্যই শরীয়ত সমর্থন করেনা এমন সকল নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং খেলাধুলা করা এবং দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।