আব্দুল হামীদ মাদানী
আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগত আলেম ও দাঈর নির্দিষ্ট পরিচয়ের কোন রঙ নেহ।
ইবনুল কাইয়্যেম (রঃ) অনুগত বান্দার লক্ষণ উল্লেখ ক’রে বলেন, “সে কোন নির্দিষ্ট (দলীয়) নামের বাঁধনে নিজেকে বঁধে না, কোন পরিকল্পনা বা প্রতীকের ফাঁদে সে ফাসে না, কোন নির্দিষ্ট নাম বা পরিচ্ছদে সে সুপরিচিত হয় না এবং মনগড়া কল্পিত পদ্ধতি ও নীতিও সে মানে না। বরং যখন সে জিজ্ঞাসিত হয় যে, “তোমার গুরু কে?” তখন বলে, রসূল।” “তোমার নীতি কী?” বলে, ‘অনুসরণ।” “তোমার পরিচ্ছদ কী?” বলে, “সংযম (তাকওয়া)৷” “তোমার মযহাব কী?” বলে, (ক্বুরআন ও) সুন্নাহর প্রতিষ্ঠা।” “তোমার উদ্দেশ্য কী?” বলে, “আল্লাহর সন্তুষ্টি।” “তোমার খানকাহ কোথায়?” বলে, “মসজিদ।” “তোমার বংশ কী?” বলে, “ইসলাম।”
শায়খ বাকর আবু যায়দ তালেবে ইলমকে সম্বোধনপূর্বক অসিয়ত ক’রে বলেন, ‘ইসলাম (আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ) ও সালাম (শান্তি) ছাড়া মুসলিমদের আর কোন নিদর্শন নেই। অতএব হে তালেব ইলাম!! আল্লাহ তোমার মধ্যে ও তোমার ইলমে বার্কত দান করুন। ইলম সন্ধান কর। আমল অন্বেষণ কর এবং আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান কর সলফের পথ ও পদ্ধতিমতে। কোন জামাআতে (দলে বা সংগঠনে) প্রবেশ করো না। তা করলে প্রশস্ততা থেকে তুমি সন্ধীর্ণ খাচায় বন্ধ হয়ে যাবে। ইসলামের পুরোটাই তোমার জন্য চলার পথ ও জীবন-পদ্ধতি এবং সমগ্র মুসলিমরাই এক জামাআত। আর আল্লাহর হাত জামাআতের উপর। যেহেতু ইসলামে কোন দলাদলি নেই। আমি তোমার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি যে, তুমি যেন বিছিন্ন হয়ে বিভিন্ন বাতিল ফির্কা, জামাআত, মাযহাব এবং অতিরঞ্জনকারী দলের মাঝে দৌড়ে না যাও, তার উপর তুমি তোমার সম্প্রীতি ও বিদ্বেষের বুনিয়াদ না রাখ। সুতরাং তুমি রাজপথের তালেবে ইলম হও, সুন্নাহর অনুসারী হও, সলফের (সাহাবাবৃন্দের) পদাঙ্কানুসরণ কর, সজ্ঞানে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান কর। মানীদের মান ও অগ্রগামিতা স্বীকার কর। জেনে রেখো, অভিনব গঠন ও গতিভিত্তিক দলাদলি—যা সলফের যুগে পরিচিত ছিল না।–তা ইলমের পথে প্রধান প্রধান প্রতিবন্ধকসমূহের অন্যতম এবং জামাআত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ। যেহেতু এই দলাদলিই ইসলামী সংহতির রজজুকে কত ক্ষীণ ক’রে ফেলেছে এবং এরই কারণে মুসলিম সমাজে কত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমার প্রতি সদয় হন, তুমি বিভিন্ন দল ও ফির্কা থেকে সাবধান হও; যার চক্রান্ত ও দুরভিসন্ধি সুস্পষ্ট। এ সমস্ত দল তো গৃহছাদে সংযুক্ত পানি নিকাশের পাইপের মত, যা ঘোলা পানি সমূহকে (নিজের মধ্যে একত্রে) জমা করে এবং নিরর্থক বর্জন করে। তবে হ্যা, তোমার প্রতিপালক যার প্রতি করুণা করেছেন, ফলে সে নবী ﷺ ও তার সাহাবাবৃন্দের পথে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” (তাসনীফুন্নাস) সুতরাং দাঈর উচিত, দলাদলির ছোবল থেকে দূরে থাকা। দলাদলি থেকে সেইরূপ দূরে পলায়ন করা, যেমন বাঘ দেখে দূরে পলায়ন করা হয়। সত্যিকারের একজন আলেম হবেন। উদার মনের, ভিতর-বাহির সমান পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের। পরন্তু কোন দলের কবলে পড়লে তার হৃদয়ে বিদ্বেষ, রেষারেষি, খোটা-খোচা ও পরচর্চার নিরাপদ স্থান লাভ করবে। কারণ ফির্কাবন্দী ও দলাদলি স্বামী-স্ত্রীর মাঝেও বিচ্ছেদ ঘটায়। দাঈ কোন নির্দিষ্ট দল বা জামাআতের হলে তিনি দাওয়াতের ময়দানে অনেক লোককে হারাবেন। নির্দিষ্ট নাম ও প্রতীক ব্যবহার ক’রে দাওয়াত দিলে অনেক মানুষ তার নিকট থেকে দূরে সরে যাবেন। আহলে ইলম হলে তার মূল্যবান ইলম থেকে বহু মুসলমান বঞ্চিত হয়ে যাবেন। অথচ তা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনেক দল ও জামাআত সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনকালে বহু ফির্কা প্রকাশ পেয়েছে, যেমন খাওয়ারিজ, মু’তাযিলা, জাহমিয়্যাহ, শিয়া প্রভৃতি। বর্তমান যুগেও বহু ফির্কা ও জামাআত নিজ নিজ সঠিকতার দাবী নিয়ে ময়দানে কাজ করছে। দাঈর উচিত, সে সকল ফির্কা ও জামাআতকে ডাহনে-বামে ফেলে রেখে সরল পথে সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া। হুযাইফাহ বিন য়্যামান বলেন, লোকেরা আল্লাহর রসূল ﷺ কে ইষ্ট ও মঙ্গল বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত, আর আমি ভূক্তভোগী হওয়ার আশঙ্কায় অনিষ্ট ও অমঙ্গল বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। একদা আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা মূর্খতা ও অমঙ্গলে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে এই মঙ্গল দান করলেন। কিন্তু এই মঙ্গলের পর আর অমঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, আছে।” আমি বললাম, অতঃপর ঐ অমঙ্গলের পর আর মঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, আর তা হবে ধোঁয়াটে” (অর্থাৎ, বিশুদ্ধ ও খাটি মঙ্গল থাকবে না। বরং তার সাথে অমঙ্গল, বিঘ্ন, মতানৈক্য এবং চিত্ত-বিকৃতির ধোঁয়াটে পরিবেশ থাকবে।) আমি বললাম, তার মধ্যে ধোঁয়াটা কি?” তিনি বললেন, “এক সম্প্রদায় হবে, যারা আমার সুন্নাহ (তরীকা) ছাড়া অন্যের সুন্নাহ (তরীকা) অনুসরণ করবে এবং আমার হেদায়াত (পথনির্দেশ) ছাড়াই (মানুষকে) পথপ্রদর্শন করবে। যাদের কিছু কাজকে চিনতে পারবে (ও ভালো জানবে) এবং কিছু কাজকে অদ্ভূত (ও মন্দ) জানবে।” আমি বললাম, “ঐ মঙ্গলের পর আর অমঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, (সে যুগে) জাহান্নামের দরজাসমূহে দন্ডায়মান আহবানকারী (আহবান করবে)। যে ব্যক্তি তাদের আহবানে সাড়া দেবে, তাকে তারা ওর মধ্যে নিক্ষিপ্ত করবে।” আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে তাদের পরিচয় বলে দিন।” তিনি বললেন, “তারা আমাদেরই চর্মের (স্বজাতি) হবে এবং আমাদেরই ভাষায় কথা বলবে।” আমি বললাম, “আমাকে কি আদেশ করেন -যদি আমি সে সময় পাই?” তিনি বললেন, “মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম (নেতা)র পক্ষাবলম্বন করবে।” আমি বললাম, কিন্তু যদি ওদের জামাআত ও ইমাম না থাকে?” তিনি বললেন, “ঐ সমস্ত দল থেকে দূরে থাকবে; যদিও তোমাকে কোন গাছের শিকড় কামড়ে থাকতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার ঐ অবস্থাতেই মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত। ৫৩৮২নং) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বলেন, একদা রসূল ﷺ স্বহস্তে একটি (সরল) রেখা টানলেন, অতঃপর বললেন, “এটা আল্লাহর সরল পথ।” তারপর ঐ রেখাটির ডানে ও বামে আরো অনেক রেখা টেনে বললেন, “এই হচ্ছে বিভিন্ন পথ, যার প্রত্যেকটির উপর রয়েছে শয়তান, যে ঐ পথের দিকে আহ্বান করে (দাওয়াত দিতে) থাকে।” অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ-
وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থাৎ, নিশ্চয় এটিই আমার সরল পথ, সুতরাং এরই অনুসরণ কর ও বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দান করেছেন যেন তোমরা সাবধান হও। (সূরা আনআম ১৫৩ আয়াত, আহমাদ, হকেম মিশকাত ১/৫৯)
আল্লাহর রসূল ﷺ বলেন, “ইয়াহুদী একাত্তর দলে এবং খ্রিস্টান বাহাত্তর দলে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। আর এই উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার মধ্যে একটি ছাড়া বাকী সব ক’টি জাহান্নামী হবে।” অতঃপর ঐ একটি দল প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, “তারা হল জামাআত। যে জামাআত আমি ও আমার সাহাবা যে মতাদর্শের উপর আছি, তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (সুনান আরবাআহ, মিশকাত ১৭১-১৭২, সিলসিলাহ সহীহাহ ২০৩, ১৪৯২নং) ইরবায বিন সারিয়াহ (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল ﷺ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ (পথ ও আদর্শ) এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ অবলম্বন করো। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, দাঁতে কামড়ে ধরো। আর দ্বীনে নবরচিত কর্ম থেকে সাবধান থেকো। কারণ প্রত্যেক নবরচিত (দ্বানী) কর্মই হল ‘বিদআত’। আর প্রত্যেক বিদআতই হল ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ আবু দাঊদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৮১৫ নং ইবনে মাজাহ মিশকাত ১৬৫নং) বলা বাহুল্য, উপর্যুক্ত হাদীসসমূহে সিরাতে মুস্তাকীম” তথা সাহাবা ও সলফে সালেহীনের পথ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এবং সেই সাথে নানা ফির্কা থেকে দূরে থাকতে তাকীদ করা হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, সেই রাজপথের পথিক হওয়া, যে পথ বড় উজজল, যে পথের রাতটাও দিনের মতো। সেই মেরুদন্ডসম পথকেই সালফিয়াত বলা হয়। যেহেতু সে পথের পথিকরা সলফ তথা সাহাবাগণের বুঝ অনুসারে কুরআন-হাদীস বুঝে। যাদের পথ অবলম্বন ছাড়া মুসলিম বেহেশতের পথ পেতে পারে না।
মহান আল্লাহ বলেন
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং বিশ্বাসীদের পথ ভিন্ন অন্য পথ অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে সে ফিরে যেতে চায় এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। আর তা কত মন্দ আবাস! (নিসাঃ ১১৫) এখানে জেনে রাখা ভাল যে, সালাফিয়াত কোন মযহাব বা ফির্কার নাম নয়। এ হল প্রকৃত ও আসল ইসলামের নাম। মুসলিমদের নানা মত ও নানা পথ হওয়ার সময় যে ব্যক্তি সলফদের মত ও পথ অবলম্বন করে, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত ও আসল মুসলিম। পক্ষান্তরে যদি কেউ জানতে চায় যে, সালাফীদের নেতা কে? তাহলে তার জেনে রাখা উচিত যে, সাহাবাদের নেতা শেষ নবী মুহাম্মদ ﷺ । আর সে যদি তাদের পথ ধরে চলে, তাহলে সেও সালাফী, অর্থাৎ সেই আসল মুসলিম। তারা এবং তার অনুসারীরাই হল (হাদীসে বর্ণিত) ‘জামাআত”। তারাই হলেন নানা ‘আহলে বিদআহ ও ফুরক্বাহ’র মাঝে ‘আহলে সুন্নাহ অলজামাআহ’। তারাই হলেন ‘জামাআতুল মুসলিমীন’। নানা আক্কেলপন্থীদের মাঝে তারাই হলেন সুন্নাহ বা হাদীসপন্থী। তাদেরকেই “আহলে সুন্নাহ বা হাদীস বা আষার” বলা হয়। যেহেতু অন্যেরা যখন আক্কেল থেকে দলীল দেয়, তখন তারা সুন্নাহ ও হাদীস থেকে দলীল পেশ করেন। অন্যেরা যখন অন্যের ‘সুন্নাহ’ (তরীকা)কে অবলম্বন করে, তারা তখন নবীর ‘সুন্নাহ’ ও তরীকাকে অবলম্বন করেন। অন্যেরা মতভেদের সময় যখন ‘অমুক-তমুক’-এর পক্ষাবলম্বন করেন, তারা তখন নবী ও তার সাহাবার পক্ষাবলম্বন করেন। কোন মতভেদের সময় যখন অন্যেরা ‘অমুক-তমুক’-এর পক্ষপাতিত্ব করে, তখন তারা কেবল কিতাব ও সুন্নাহর পক্ষপাতিত্ব করেন। মতভেদ তো হতেই পারে, তা বলে কি তার ফায়সালা নেই? অবশ্যই আছে। অন্যেরা অন্যের ফায়সালা মানে, আর তারা মানেন আল্লাহ ও তার রসূলের ফায়সালা। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
অর্থাৎ, হে বিশ্ববাসিগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্ববাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও। আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (নিসাঃ ৫৯) তারাই হলেন জামাআত। এক রাষ্ট্রে একই নেতার নেতৃত্তে ঐক্যবদ্ধ জামাআত অথবা নবী ও সাহাবার পথের অনুগামী জামাআত, চাহে তার সংখ্যা কম হোক বা বেশি। যেহেতু অনুগামীদের সংখ্যাধিক্য হকের দলীল নয়। সংখ্যায় কম হলেও কষ্টিপাথরে যারা হকপন্থী, তারাই হকপন্থী। আর হকপন্থীর সংখ্যা কমই হয়ে থাকে; যেমন কুরআন-হাদীসে সে কথার বহু প্রমাণ রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) বলেন, ‘হকের অনুসারীই হল জামাআত, যদিও তুমি একা হও” (ইবনে আসাকের মিশকাত ১/৬১ টীকা নং ৫) সেই জামাআতই হল ‘ফির্কাহ নাজিয়াহ ও তায়েফাহ মানসূরাহ”। এই দলের ব্যাপারেই প্রিয় নবী ﷺ বলেছেন, “সর্বকালে আমার উম্মতের একটি দল হকের সাথে বিজয়ী থাকবে, তাদেরকে যারা উপেক্ষা করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না; যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্ব মুহুর্ত) এসে উপস্থিত হবে।” (মুসলিম) ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদেরকে যে যে উপাধি দিয়ে ভূষিত করা হয়েছে, তা কিন্তু কোন স্থান-কাল-পাত্রের সাথে নির্দিষ্ট নয়। যেহেতু ইসলামের ফজর থেকে নিয়ে কিয়ামত আসার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সেই জামাআত অবশিষ্ট আছে ও থাকবে। উক্ত উপনামে ইসলামের সকল দিক শামিলও আছে। আকীদা, আহকাম, আখলাক, মাসায়েল, ফাযায়েল, জিহাদ, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি সব কিছু। কোন এক বা একাধিক দিক ছেড়ে অন্য একটা দিক নিয়ে সে দল পরিচিত ও প্রসিদ্ধ হয় না। কেবল তাবলীগ নিয়ে, অথবা কেবল জিহাদ নিয়ে, অথবা কেবল ইসলামী রাষ্ট্রগঠন নিয়ে এক এক প্রবণতায় এক এক দলে ও জামাআতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। কোন শির্ক-বিদআত নিয়ে তো নয়ই, কোন ব্যক্তি বিশেষের মত নিয়েও কোন দল বা জামাআত সৃষ্টি করে না। “বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও হাদীস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবী ও তাবেঈনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তাঁরা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল ﷺ । কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন (ভক্তিভাজন) ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হল। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হল, যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল। এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।” (আহসানুল বায়ান ৯৩পৃঃ) মুসলিমদের এই জামাআত ইসলামের স্বর্ণযুগে কেবল “মুসলিম” বলেই পরিচিত ছিল। আল্লাহর নবী ﷺ -এর যুগে কোন দলাদলি ছিল না। বরং তিনি এই শ্রেণীর দলাদলির বিভক্তিকে অপছন্দ করতেন। বানী মুস্তালাক্ব যুদ্ধে এক আনসারী ও এক মুহাজিরীর মধ্যে কোন কলহ বাধলে আনসারী আনসারের নাম ধরে এবং মুহাজিরী মুহাজিরীনের নাম ধরে আহবান করলেন। তা শুনে মহানবী ﷺ বললেন, “জাহেলিয়াতের আহবান? অথচ আমি তোমাদের মাঝে রয়েছি! তা বর্জন কর, কারণ তা পচা (দুর্গন্ধময়)।” (তিরমিয়ী,৩৩১৫নং)
নববী যুগ ছিল অন্ধ পক্ষপাতিত্ব বর্জিত। তখন কোন দলাদলি বা ফির্কামাযহাব ছিল না। মুনাফিক ছাড়া সকল মুসলিমগণ এক জামাআতের ছিলেন। মহানবী ﷺ জামাআতবদ্ধভাবে বাস করার তাকীদও দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা জামাআতবদ্ধভাবে বাস কর এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থেকে। সুতরাং যে জান্নাতের মধ্যস্থল পেতে চায়, সে যেন জামাআতের সাথে থাকে।” (কিতাবুস সুন্নাহ শায়বানী ৮৯৭নং) “জামাআত (ঐক্য) হল রহমত এবং বিচ্ছিন্নতা হল আযাব।” (মুসনাদে আহমাদ, কিতাবুস সুন্নাহ শায়বানী ৮৯৫ সহীহুল জামে’ ৩১০৯নং) “যে ব্যক্তি আনুগত্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিল, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার জন্য কোন প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বায়আত না করে মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মরা মরল।” এর অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, “যে ব্যক্তি জামাআত ত্যাগ ক’রে মারা গেল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম) “যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার ক’রে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যেটি (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আবু দাঊদ-হাসান সূত্রে) বর্ণনাকারী সায়েব বলেন, “এখানে জামাআত বলতে উদ্দেশ্য নামাযের জামাআত।” আর তার প্রমাণ হাদীসের প্রথমাংশ। “জামাআতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। সুতরাং যে (জামাআত থেকে) পৃথক হবে, সে পৃথক হয়ে জাহান্নামে যাবে।” (তিরমিযী) “আমার (অন্তর্ধানের) পরে অনেক কিছু (আপত্তিকর ঘটনা) ঘটবে। সুতরাং যাকে জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখবে অথবা উম্মতে মুহাম্মাদিয়্যাহর ঐক্যকে নষ্ট করতে দেখবে, তাকে হত্যা ক’রে ফেলো, তাতে সে যেই হোক না কেন।” (মুসলিম)
নচেৎ বুঝতেই তো পারছেন, যে কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত নয়, সে হত্যাযোগ্য নয়। বরং এ হাদীসে স্পষ্টভাবে দলাদলি ও ঐক্যবদ্ধ জামাআতকে ভাগাভাগি করতে নিষেধ করা হয়েছে। “তিন ব্যক্তি সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করো না; যে জামাআত ত্যাগ করে নেতার অবাধ্য হয়ে মারা যায়, যে ক্রীতদাস বা দাসী প্রভু থেকে পলায়ন করে মারা যায়, এবং সেই নারী যার স্বামী অনুপস্থিত থাকলে—তার সাংসারিক সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস বন্দোবস্ত করে দেওয়া সত্তেও—তার অনুপস্থিতিতে বেপর্দায় বাইরে যায়।” (সিলসিলা সহীহাহ ৫৪২নং)
“যে ব্যক্তি জামাআত থেকে আধ হাত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হল সে যেন ইসলামের রশিকে নিজ গলা হতে খুলে ফেলল। তবে যদি সে পুনরায় জামাআতে ফিরে আসে। তবে ভিন্ন কথা।” (আহমাদ, সহীহ তিরমিযী ২২৯৮ সহীহুল জামে’ ১৭২৮নং)
“তিনটি বিষয় এমন আছে, যাতে কোন মুসলিমের হৃদয় খিয়ানত করতে পারে না। (এক) নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্য আমল করা। (দুই) সাধারণ মুসলিমদের জন্য কল্যাণ কামনা করা। (তিন) মুসলিমদের জামাআতকে আঁকড়ে ধরে থাকা। কেননা, তাদের (ঐক্যবদ্ধতার) আহবান তাদের সকলকে পরিবেষ্টন করে রাখে।” (মিশকাত তাহক্বীক্ব সহ হাদীস নং২২৮) উমার (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) বলেছেন, ‘জামাআত ছাড়া ইসলাম নেই। নেতৃত্ব ছাড়া জামাআত নেই। আর আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব নেই।’ (দরেমী ২৫১নং) বুঝতেই পারছেন যে, উক্ত নির্দেশাবলিতে ‘জামাআত’ বলতে কোন সংগঠন, জামাআত বা দল নয়। আর বায়আত বলতে রাষ্ট্রনেতার হাতে আনুগত্যের বায়আত। সুতরাং উক্ত বাণীসমূহকে সংগঠন অর্থে ব্যবহার ক’রে ইসলামের মাঝে দল তৈরি করা অবশ্যই বৈধ নয়। যেমন জান-মাল দিয়ে জিহাদ করার আয়াত ও হাদীসসমূহকে তাবলীগের অর্থে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়, যদিও তাবলীগ এক প্রকার জিহাদ এবং জিহাদে তাবলীগ আছে। জ্ঞাতব্য যে, কোন দল বা ফির্ক সৃষ্টি না ক’রে কিছু লোকের দাওয়াতের কাজ জামাআতবদ্ধভাবে করা। আপত্তিকর নয়। যেমন সফরে একাধিক লোক গেলে জামাআত ও আমীর এবং মসজিদে-মসজিদে জামাআত ও ইমাম উক্ত হাদীসসমূহের পরিপন্থী নয়।
সামাপ্ত
(সূত্রঃ- আব্দুল হামীদ মাদানী, দ্বীনের দাওয়াত, ১২৮-১৩৫ পৃষ্ঠা,)।