দাইয়্যুস সম্পর্কে বিস্তারিত

দাইয়্যুস শব্দের অর্থ কি? দাইয়্যুস কাদেরকে বলা হয়? শরীয়তের দৃষ্টিতে দাইয়্যুসের পরকালীন পরিণতি কেমন হতে পারে? আজ আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
দাইয়্যুস আরবী (دَيُّوث) শব্দ দাইয়্যুস শব্দের অর্থ হল, কলুষিত ও কদর্য বিবেকসম্পন্ন, ব্যভিচারের দূত, নারী-পুরুষের অবৈধ মিলনের দূত। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যিনা-ব্যভিচার ও অশ্লীল কাজ-কর্মকে ভাল মনে করে গ্রহণ করে অথবা প্রতিবাদ না করে চুপ থাকে। (আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ,২১/৯৬ পৃ.)।
.
দাইয়ূসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দাইয়্যুস’ সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর ফাহেশা কাজ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসার কারণে উক্ত ব্যপারে সে উদাসীন থাকে। অথবা তার উপর তার স্ত্রীর বৃহৎ ঋণ বা মোহরানার ভয়ে কিংবা ছোট ছেলেমেয়েদের কারণে সে স্ত্রীকে কিছুই বলে না এবং যার আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছুই নেই।’ (ইমাম যাহাবী, কিতাবুল কাবায়ের ১/৫০ পৃঃ)
.
ইবনু হাজার হাইথামি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,قال العلماء : الديوث الذي لا غيرة له على أهل بيته ‘আলেমগণ বলেছেন, দাইয়্যুস বলা হয়, যে নিজের পরিবারের অশ্লীলতার ব্যাপারে দায়িত্ববোধহীন বা আত্ম মর্যাদাহীন।’ (আযযাওয়াজির ২/৩৪৭)
.
মোটকথা দাইয়্যুস বলতে বুঝায়, যে ব্যক্তি তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদেরকে যিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অশ্লীল, বেহায়াপনা-বেলেল্লাপনা, অশালীন আচার-আচরণ এবং শাস্তিযোগ্য পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে না, বাধা প্রদান করে না, উপরন্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং বোবা শয়তানের ন্যায় বধির ও অন্ধের মত চোখ বুজে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করে। আর তাদের অবাধ বিচরণে ও তাদের হীন চরিতার্থ করণার্থে সার্বিকভাবে সহযোগিতার হস্তদ্বয় প্রসারিত করে বলেই তারা দাইয়্যুস।’ (মির‘আতুল মাফাতীহ, ৬/২৩৯৯; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ২/৪৮; ইসলাম সাওয়াল ওয় জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৫১১০৪)।
.
‘দাইয়্যুস এর পরিচয় দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ) বলেন, اَلدَّيُّوْثُ الَّذِي يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخَبَثَ ‘দাইয়্যুস’ বলতে বুঝায় ঐ ব্যক্তিকে, যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে মেনে নেয়।’ (সুনানে নাসাঈ হা/২৫৬২; মুসনাদে আহমাদ হা/৫৩৭২, ৬১১৩)।
.
তিনি অন্য বর্ণনায় বলেন, الَّذِيْ لَا يُبَالِيْ مَنْ دَخَلَ عَلٰى أَهْلِهِ ‘দাইয়্যুস বলতে বুঝায় ঐ ব্যক্তিকে, যে তার পরিবারের নিকট কে প্রবেশ করল (অর্থাৎ কে এলো আর গেল) এ ব্যাপারে কোন ভ্রক্ষেপ করে না। (বাইহাক্বী হা/১০৮০০; সহীহ আত-তারগীব ওয়া তারহীব হা/২০১৭, ২৩৬৭)।
.
সালিম এর পিতা আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তিন ব্যক্তির প্রতি মহামহিয়ান আল্লাহ্‌ তা’আলা কিয়ামতের দিন দৃষ্টি দিবেন না (রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না)।তারা হলেন: পিতা মাতার অবাধ্য (সন্তান), পুরুষের বেশধারী নারী এবং দায়্যুস (নিজ স্ত্রী কন্যার পাপাচারে যে ঘৃণাবোধ করেনা।) আর তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। যথা: পিতা মাতার অবাধ্য (সন্তান), মাদকাসক্ত ব্যক্তি (যে মদ্যপ তাওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করে) এবং দানকৃত বস্তুর খোঁটা দানকারী ব্যক্তি (দান করার পর যে দানের উল্লেখ করে গঞ্জনা দেয়। (নাসাঈ, যাকাত অনুচ্ছেদ ২৫৬২ মুসনাদে আহমাদ ২/১৩৪ সনদ সহীহ)
.
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবেন না। (১) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, (২) পুরুষের বেশধারী নারী এবং (৩) দাইয়্যুস অর্থাৎ নিজ স্ত্রীর পাপাচারে যে ঘৃণাবোধ করে না।’ (নাসাঈ হা/২৫৬৪; মুসনাদে আহমাদ হা/৬১৮০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৬৭৩ ও ৬৭৪)।
.
অন্যত্র তিনি বলেন, তিন শ্রেণীর মানুষ কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (১) দাইয়্যুস, (২) পুরুষের বেশধারী নারী এবং (৩) মাদকাসক্ত ব্যক্তি। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! দাইয়্যুস কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘দাইয়্যুস’ বলতে বুঝায় ঐ ব্যক্তিকে যে তার পরিবারের নিকট কে প্রবেশ করল (অর্থাৎ কে এলো আর গেল) এ ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ করে না।’ (বাইহাক্বী, হা/১০৮০০; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২০১৭, ২৩৬৭)।
.
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। (১) মাদকাসক্ত ব্যক্তি, (২) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং (৩) এমন দাইয়ূস যে ব্যক্তি তার পরিবারের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে মেনে নেয়।’ (সুনানে নাসাঈবহা/২৫৬২; মুসনাদে আহমাদবহা/৫৩৭২, ৬১১৩ মিশকাত হা/৩৬৫৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/৬৭৪)। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী হানাফি রহ. বলেন, যার চুপ থাকার কারণে তার স্ত্রী-কন্যা, দাসী প্রভৃতি নিকটতম মহিলাদের মধ্যে ব্যভিচার, মদ্যপান ও ব্যভিচারমূলক কাজ-কর্ম স্থায়িত্ব ও ব্যাপকতা লাভ করে (মিরক্বাত,হা/৩৬৫৫)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায়র দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক পুরুষ তারা নিজেদের স্ত্রী’র সুন্দর ছবি আপলোড করে সবাইকে দেখার জন্য অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। কেউবা ইউটিউবে বা টিকটক স্বামী স্ত্রী মিলে বিভিন্ন কন্টেন্ট আপলোড করে অর্থ উপার্জন করে। আবার অনেক মুসলিম পুরুষকে দেখা যায়,তারা তাদের স্ত্রী কন্যাকে হিজাব নিকাব পরিয়ে বাইরে নিয়ে যায়; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের শরীরের গঠন বুঝা যায় যার জন্য পর পুরুষেরা তাদের স্ত্রী কন্যাদের দেখে কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আবার অনেক পরহেজগার পিতা/অভিভাবক তার পরিবারের অনেক অশ্লীল কাজ দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন! বা অনেকে ছোট-খাট ব্যাপার মনে করে এইগুলো কে উড়িয়ে দেন! যারা নিজেদের স্ত্রী কন্যাকে সাজিয়ে গুজিয়ে পর পুরুষের উপভোগের জন্য খোলা ময়দানে বা রাস্তা ঘাটে বেড়াতে পাঠায় বা পরিবারে বেহায়াপনার সুযোগ দেয় শরীয়তের দৃষ্টিতে সেসকল পুরুষ ‘দাইয়্যুস’। আর দাইয়্যুস জাহান্নামী এবং কবিরা গুনাহকারী। মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্যতা করে না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে।” (সূরা আত-তাহরীম,৬৬/৬)। ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারী ২৫৫৮, ৫২০০, ৭১৩৮; মুসলিম ১৮২৯; তিরমিযী ১৭০৫; আবূ দাউদ ২৯২৮) মহান আল্লাহ আমাদেরকে সকল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: