ছোট বাচ্চাদেরকে কত বছর বয়স থেকে নামাজ-রোজার নির্দেশ প্রদান করতে হবে? এ ক্ষেত্রে পিতামাতা ও অভিভাবকের দায়িত্ব কী?
ইসলামে প্রাপ্ত বয়স্ক (Adult) হওয়ার পূর্বে নামাজ, রোজা সহ কোনও ইবাদতই বান্দার উপর ফরজ হয় না। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই বান্দার উপর নামাজ-রোজা, হালাল-হারাম, পাক-পবিত্রতা ইত্যাদি বিধান ফরজ হয়; তার আগে নয়। ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে এ কথা প্রযোজ্য।
মা আয়েশা রা. সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ المُبْتَلَى حَتَّى يَبْرَأَ، وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَكْبُرَ
“তিন ধরণের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। যথা:
১. ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয়,
২. অসুস্থ (পাগল) ব্যক্তি, যতক্ষণ না আরোগ্য লাভ করে এবং
৩. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক, যতক্ষণ না প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
[সুনান আবু দাউদ (তাহকিক কৃত) ৩৩/ অপরাধ ও তার শাস্তি, পরিচ্ছেদ: ১৬. পাগল চুরি বা দণ্ডযোগ্য অপরাধ করলে-সহিহ]
❑ সন্তান-সন্তুতির প্রতি পিতামাতার অপরিহার্য দায়িত্ব:
আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে পিতামাতা ও অভিভাবকের উপর আবশ্যক হল, তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার যে সকল সুপরিচিত চিহ্ন রয়েছে সেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের আচার-আচরণে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আলামতগুলো প্রকাশিত হয়েেছে কি না সে বিষয়ে সচেতন থাকা। অত:পর প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তাদের উপর আল্লাহর অবধারিত ‘হক’ সমূহ এবং দ্বীনের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য কি তা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া। যেন তারা প্রাপ্ত বয়স্কে উপনীত হলে আল্লাহর ফরজ ইবাদত সমূহ পালন, হালাল-হারাম পার্থক্য করা, শরিয়ত নির্দেশিত বিধিবিধান মেনে চলার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ক্রোধ থেকে বাঁচার সর্বাত্মক চেষ্টা করে এবং এ ক্ষেত্রে অবহেলা, অবহেলা বা ঢিলেমি করার কোনও সুযোগ না পায়।
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।” [সূরা তাহরীম: ৬]
মহান আল্লাহ তাদের প্রতি কেবল এ দায়িত্ব অর্পন করেই ক্ষান্ত হন নি বরং তিনি তাদেরকে কিয়ামতের দিন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করবেন। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
“জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব-
ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান), জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
কোন ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৯৩/ আহ্কাম (كتاب الأحكام), পরিচ্ছেদঃ ৯৩/১. আল্লাহর বাণী: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও এবং রসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের। (সূরাহ আন্-নিসা ৪/৫৯)]
❑ অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদেরকে নামাজ-রোজার নির্দেশ দেয়া এবং তাদেরকে দীনও শেখানো পিতা-মাতা ও অভিভাবকের অপরিহার্য দায়িত্ব:
অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদেরকে বাল্য বয়স থেকেই নামাজ-রোজা, ওজু-গোসল, পাক-পবিত্রতা, পর্দা, মাহরাম-নন মাহরাম পার্থক্য, তাওহিদ-শিরক, সুন্নত-বিদআত, ইমান-কুফর ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দান করা এবং এ সব ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা অভিভাবকদের উপর অপরিহার্য দায়িত্ব।
তারা তাদের সন্তানকে কখনো সরাসরি নির্দেশ দিবে, কখনও উৎসাহ ও উপদেশ দিবে, কখনো ধমক দিবে- এমন কি দশ বছর বয়সের বাচ্চাদেরকে এ জন্য হালকাভাবে প্রহারেরও অনুমতি রয়েছে। যেন তারা বড় হয়ে শরিয়তের বিধি-বিধানগুলো ভালোভাবে জেনে-বুঝে, দিব্য জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সঠিক পদ্ধতিতে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি সম্পাদন করতে সক্ষম হয় এবং তা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
এমনটি করলে তাদের বাকি জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর পরিচালনা করা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
❑ কত বছর বয়স থেকে বাচ্চাদেরকে নামাজ-রোজার নির্দেশ দেয়া উচিৎ?
ইসলামি শরিয়তে সর্বনিম্ন সাত বছর বয়সের শিশুকে مميَّز বা ‘ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী’ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিভাবকদের প্রতি সাত বছরের শিশুকে নামাজের আদেশ করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,
«مُرُوا أوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاةِ وَهُمْ أبْنَاءُ سَبْعِ سِنينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ في المضَاجِعِ»
‘‘তোমরা নিজেদের সন্তান-সন্ততিদেরকে নামাজের আদেশ দাও; যখন তারা সাত বছরের হবে। আর তারা যখন দশ বছরের সন্তান হবে, তখন তাদেরকে নামাজের জন্য প্রহার কর এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’’ [আবু দাউদ। সনদ: হাসান। রিয়াযুস সালিহীন, হা/৩০৬, অধ্যায়: ১/ বিবিধ (كتاب المقدمات) তাওহীদ পাবলিকেশন]
উল্লেখ্য যে, সাত বছরের শিশু বলতে বুঝায়, যার বয়স সাত বছর পূর্ণ হয়ে আট বছর সূচনা হয়েছে।
আর রোজার ক্ষেত্রে তা তাদের শারীরিক সক্ষমতার দিকে খেয়াল রেখে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। (এ ক্ষেত্রে কোনও কোনও আলেম দশ বছরের কথা বলেছেন)। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবিগণ তাদের বাচ্চাদেরকে বাল্য বয়সে রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
রুবাঈ বিনত মুয়াওবিয ইবনে আফরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
فَكُنَّا بَعْدَ ذَلِكَ نَصُومُهُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا الصِّغَارَ مِنْهُمْ إِنْ شَاءَ اللَّهُ وَنَذْهَبُ إِلَى الْمَسْجِدِ فَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهَا إِيَّاهُ عِنْدَ الإِفْطَارِ
“অত:পর আমরা এ দিন (আশুরার দিন) সাওম পালন করতাম এবং আমাদের ছোট ছোট সন্তানদেরকেও আল্লাহ চাহে তো সাওম পালনে অভ্যস্ত করে তুলতাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম এবং তাদের জন্য পশমের খেলনা বানিয়ে দিতাম। যখন তারা খাওয়ার জন্য কাঁদত, তখন আমরা তাদেরকে সে খেলনা প্রদান করতাম। এমনি করে ইফতারের সময় হয়ে যেত।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১৪/ সিয়াম (রোজা) পরিচ্ছেদ: ১৯. আশুরার দিনে কেউ ভোরে খেয়ে ফেললে অবশিষ্ট সময় সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে]
তবে রোজা রাখলে যদি তাদের শারীরিক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এ জন্য চাপ প্রয়োগ করা বৈধ নয়।
শাইখ আল্লামা উসাইমিন রহ. বলেন,
” والصغير لا يلزمه الصوم حتى يبلغ ، ولكن يؤمر به متى أطاقه ليتمرن عليه ويعتاده ، فيسهل عليه بعد البلوغ ، وقد كان الصحابة رضي الله عنهم – وهم خير هذه الأمة – يصوِّمون أولادهم وهم صغار ” انتهى . ” مجموع فتاوى الشيخ ابن عثيمين ” ( 19 / 28 ، 29 )
“আর ছোট বাচ্চার উপর রোজা রাখা আবশ্যক নয় যতদিন না প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। তবে যখন তার মধ্যে রোজা রাখার মত সক্ষমতা সৃষ্টি হবে তখন তাকে রোজা রাখার নির্দেশ দিতে হবে যেন, প্রশিক্ষণ লাভ করে এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এমনটি করলে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর তাদের জন্য তা সহজ হয়ে যাবে। সাহাবিগণ-যার ছিলেন এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ-তাদের সন্তানদেরকে বাল্য বয়সে রোজা রাখাতেন।” [মাজমু ফতাওয়া ১৯/১৮ ও ২৯]
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
ছোট শিশু নেক আমল করলে তার সওয়াব যেমন তাদের আমলনামায় লেখা হবে তেমনি তাদের পিতামাতাও সওয়াব পাবে তাকে দ্বীন পালনে আদেশ, উপদেশ, উৎসাহ প্রদান ও নানাভাব সাহায্য-সহযোগিতা করার কারণে। এমনকি তারা মারা যাওয়ার পরও কবরে সুসন্তানের দুআ দ্বারা প্রকৃত হবে।
عن كريب : أن امرأة رفعت صبيا فقالت : يا رسول الله ألهذا حج ؟ قال : نعم ، ولك أجر-رواه مسلم
عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعا : إذا مات ابن آدم انقطع عمله إلا من ثلاث : صدقة جارية ، أوعلم ينتفع به ، أو ولد صالح يدعو له
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।