কোন পুরুষের চরিত্র ও দ্বীনদারিতে আকৃষ্ট হয়ে কোন নারী কি বিয়ের জন্য নিজেই প্রস্তাব দিতে পারে

ভূমিকা: শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে পাত্র-পাত্রী উভয় পরিবারের মধ্যে প্রস্তাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ সংঘটিত হওয়াই বিবাহের শরী‘আত সম্মত পদ্ধতি, কারণ এতে ফিতনার আশঙ্কা থাকেনা।তবে যদি কোন নারীর কোন পুরুষের দ্বীনদারিত্ব, চরিত্র মাধুরী, ইসলামী জ্ঞান, নম্রতা-ভদ্রতা ইত্যাদি ভালো গুণ-বৈশিষ্টের কারণে ভালো লাগে তাহলে নিজের পক্ষ থেকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে কিংবা বুদ্ধিমান লোকদের কাছে এটা মোটেও দোষণীয় নয়।যদিও আমাদের দেশে কন্যা পক্ষ হতে বিবাহের পয়গাম দেওয়া লজ্জার ব্যাপার মনে করা হয়। কিন্তু আল্লাহর শরীয়তে তা নিন্দনীয় নয়।নবী (সাঃ) ও সাহাবা (রাঃ)-দের যুগেও এই প্রথাই প্রচলিত ছিল।সুতরাং কেউ যদি এটাকে খারাপ চোখে দেখে তাহলে তার সে দেখাটা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; বরং সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা ও অভ্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে। আবার অনেক সময় মহিলারা হিংসাবশত এটাকে খারাপ চোখে দেখে,কিন্ত শরীয়ত এটি নিষিদ্ধ করেনি। এই মর্মে সহীহ বুখারীতে হাদীস এসেছে: عن ثَابِت الْبُنَانِيِّ قَالَ : كُنْتُ عِنْدَ أَنَسٍ ، وَعِنْدَهُ ابْنَةٌ لَهُ ، قَالَ أَنَسٌ : جَاءَتْ امْرَأَةٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَعْرِضُ عَلَيْهِ نَفْسَهَا ، قَالَتْ : يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَكَ بِي حَاجَةٌ ؟ فَقَالَتْ بِنْتُ أَنَسٍ : مَا أَقَلَّ حَيَاءَهَا ، وَا سَوْأَتَاهْ ! وَا سَوْأَتَاهْ ! قَالَ : هِيَ خَيْرٌ مِنْكِ ، رَغِبَتْ فِي النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَعَرَضَتْ عَلَيْهِ نَفْسَهَا “সাবেত আল-বুনানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি আনাস (রাঃ) এর কাছে ছিলাম। তাঁর কাছে তাঁর মেয়ে ছিলেন। এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে নিজেকে (বিয়ের জন্য) পেশ করে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কি আপনার প্রয়োজন আছে? আনাস (রাঃ) এর মেয়ে বললেন: ছি! ছি! তাঁর লজ্জাবোধ কতই কম! তখন আনাস (রাঃ) বললেন: সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আগ্রহবশত তিনি তাঁর কাছে নিজেকে পেশ করেছেন।”(সহীহ বুখারী হা/৪৮২৮ ও হা/৫১২০)
.
উক্ত হাদীস উল্লেখ করে ইমাম বুখারী এ হাদিসের শিরোনাম দিয়েছেন, ” عرْض المرأة نفسَها على الرجل الصالح “সৎ লোকের কাছে কোন নারীর নিজেই প্রস্তাব দেয়া শীর্ষক পরিচ্ছেদ”(সহীহ বুখারী, ৬৭/৩৩ হা/৫১২০)
.
ইমাম বদরুদ্দিন আইনি আল হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ) বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাতুল কারী শরহে সহিহুল বুখারীতে’ লিখেছেন,

قول أنس لابنته ” هي خير منكِ ” دليل على جواز عرض المرأة نفسها على الرجل الصالح ، وتعريفه رغبتها فيه لصلاحه وفضله ، أو لعلمه وشرفه ، أو لخصلة من خصال الدين ، وأنه لا عار عليها في ذلك ، بل يدل على فضلها ، وبنت أنس – رضي الله عنه – نظرت إلى ظاهر الصورة ، ولم تدرك هذا المعنى حتى قال أنس ” هي خير منكِ ” ، وأما التي تعرض نفسها على الرجل لأجل غرض من الأغراض الدنيوية فأقبح ما يكون من الأمر وأفضحه .

“মেয়ের প্রতি আনাস রাযি. এর উক্তি: “সে মহিলা তোমার চেয়ে উত্তম” এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, একজন মহিলা একজন ব্যক্তিকে তার সততা ও মর্যাদা কিংবা জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্ব অথবা ধর্মীয় কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে সে-ই ব্যক্তি পরিচিত হওয়ায় তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। এতে কোন দোষ বা লজ্জার কিছু নেই। বরং এটি তার উত্তম গুনাবলির একটি বৈশিষ্ট্য। আর আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মেয়ে পুরুষের চেহারার বাহ্যিকতার (সৌন্দর্যতা কিংবা সম্পদ-সম্পত্তির) দিকে লক্ষ্য করলেন। অথচ তিনি এই অর্থ (উপরে উল্লেখিত গুণাবলী) বুঝতে সক্ষম হলেন না। ফলে আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন: সে মহিলা তোমার থেকে বেশি উত্তম। অতএব যে মহিলা তার নিজেকে কোনো পুরুষের কাছে দুনিয়াবি/পার্থিব উদ্দেশ্যে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তাহলে অবশ্য এটি সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও অসম্মানজনক কাজ।(উমদাতুল কারী শরহে সহিহুল বুখারী: খন্ড: ২০, পৃষ্ঠা: ১১৩)

এছাড়াও জনৈক সৎ নারী নিজে থেকে মুসা (আঃ) এর সাথে বিয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিতে গিয়ে বলেন: যেমনটি আল্লাহ তাআলা উদ্ধৃত করেছেন, “নারীদ্বয়ের একজন বলল, আব্বু আপনি তাকে মজুর নিয়োগ করুন। কারণ আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।[সূরা কাসাস; আয়াত: ২৬] এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে মেয়েটির পিতা তাকে মূসা (আঃ) এর নিকট উপস্থাপন করেছেন। যেমনটি বুঝা যায় এ কথা থেকে “তিনি মূসাকে বললেন: আমি আমার এ কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার মজুরি খাটবে।”[সূরা কাসাস; আয়াত: ২৭) এই সৎ লোকের মেয়েটি ইঙ্গিত দেয়ার পর লোকটি নিজের মেয়েকে মূসা (আঃ) এর কাছে পেশ করলেন। অনুরূপভাবে প্রথম হাদীসে জনৈক মহিলা সরাসরি নিজেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করেছেন। এ ঘটনাগুলো লজ্জাশীলতার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং এ ঘটনাগুলো মজবুত দ্বীনদারি, সংশ্লিষ্ট মহিলা ও তার অভিভাবকের বুদ্ধির প্রখরতার প্রমাণ বহন করে। সুতরাং একজন মহিলা ইচ্ছেে করলে সরাসরি কোন পুরুষের নিকট তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে অথবা নিজের পিতা বা অভিভাবককে পছন্দের কোন পুরুষকে বিয়ের জন্যও বলতে পারে।
.
আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ গ্রন্থে এসেছে-

يجوز عرض المرأة نفسها على الرّجل ، وتعريفه رغبتها فيه ، لصلاحه وفضله ، أو لعلمه وشرفه ، أو لخصلة من خصال الدِّين ، ولا غضاضة عليها في ذلك ، بل ذلك يدلّ على فضلها ، فقد أخرج البخاريّ من حديث ثابت البنانيّ قال : كنت عند أنس … – وذكروا الحديث السابق

“কোন পুরুষের দ্বীনদারি, মর্যাদা, ইলম, কিংবা বিশেষ কোন দ্বীনি বৈশিষ্ট্যে বিমোহিত হয়ে কোন নারীর জন্য নিজেকে সে পুরুষের কাছে উপস্থাপন করা ও পরিচয় তুলে ধরা জায়েয আছে; এতে দোষের কিছু নেই। বরং এটি সে নারীর মর্যাদারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে সহিহ বুখারীতে সাবেত আল-বুনানী থেকে বর্ণনা এসেছে যে, তিনি বলেন: আমি আনাস (রাঃ) এর কাছে ছিলাম… এরপর পূর্ণাঙ্গ হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে।(আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যা; খন্ড: ৩০; পৃষ্ঠা: ৫০)
.
তবে যে নারী কোন দ্বীনদার পুরুষকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চায় তার ক্ষেত্রে আমাদের উপদেশ হচ্ছে তিনি যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চান তাকে সরাসরি প্রস্তাব কিংবা ফোনে মেসেজ না পাঠিয়ে সম্ভব হলে নিজ পরিবারের কাছে বিষয়টি শেয়ার করতে পারেন কিংবা কারো মাধ্যমে জানাতে পারেন। এর কোনটিই সম্ভব না হলে পরিচিত করো মাধ্যমে তার কাছে প্রস্তাব দিতে পারেন। আমাদের মতে, সরাসরি প্রস্তাব দেয়ার চেয়ে এটি উত্তম। এক্ষেত্রে একটি বিষয় সর্বদা মাথায় রাখতে হবে। আর তা হল কোন ছেলেকে বা ছেলে মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার নামে তার সাথে গোপনে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া জায়েয নেই। আর পরিচয়ের নামে গোপনে তার সাথে একান্ত জরুরি ছাড়া কথা-বার্তা বৈধ নয়, এমনকি তাদের দু’জনের বিয়ের নিয়ত থাকলেও। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা বেগানা নারীর সাথে নিভৃতে অবস্থান করা, মুসাফাহা করা ও দৃষ্টিপাত করা হারাম করেছেন; কেবলমাত্র বিয়ের পাত্রী দেখা ও সাক্ষ্যদানের মত প্রয়োজন ছাড়া। সাজগোজ করে বেপর্দা হয়ে বের হওয়া নারীর উপর হারাম করেছেন। গাইরে মাহরাম পুরুষদের সামনে সতর খোলা, তাদের মাঝে সুগন্ধি মেখে বের হওয়া ও তাদের সাথে কোমল সুরে কথা বলা হারাম করেছেন। এসব কর্ম হারাম হওয়া কুরআন-সুন্নাহ্‌র দলিলের ভিত্তিতে সুবিদিত। এ বিধানগুলোর আওতা থেকে কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। এমনকি কেউ বিয়ের সংকল্প করলে তাকেও নয়; বিয়ের প্রস্তাবকারী পাত্রকেও নয়। কেননা বিয়ের আকদ (চুক্তি) হওয়ার আগ পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাবকারী ছেলেও বেগানা পুরুষ। হাদিসে এসেছে
.
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন: “অবশ্যই কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নিভৃতে একত্রিত হবে না”।(সহীহ বুখারী হা/৩০০৬; ও ইমাম মুসলিম হা/১৩৪১) তিনি আরও বলেন: “সাবধান! কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নিভৃতে একত্রিত হবে না; যদি হয় সেখানে শয়তানই থাকে তৃতীয় ব্যক্তি।”[সুনানে তিরমিযি হা/২১৬৫); শাইখ আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] কোন পুরুষ কোন নারীর দিকে তাকানো হারাম হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তাআলার বাণীতে উদ্ধৃত হয়েছে যে: “মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে, লজ্জাস্থানকে হেফাযতে রাখে। এটাই তাদের পবিত্র থাকার জন্য অধিকতর সহায়ক। তারা যা কিছু করে আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে অবহিত।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩০] জারির বিন আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হঠাৎ নজর পড়ে যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন।[সহিহ মুসলিম হা/২১৫৯)। বেগানা নারীর সাথে মুসাফাহা করা হারাম হওয়া সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, “তোমাদের কারো মাথায় লোহার শলাকা দিয়ে আঘাত করা হালাল নয় এমন নারীকে স্পর্শ করার চেয়ে উত্তম।”[তাবারানী কর্তৃক বর্ণিত মা’কিল বিন ইয়াসার (রাঃ) এর হাদিস; আলবানী “সহিহুল জা’মে গ্রন্থে হা/৫০৪৫) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] এক্ষেত্রে নর-নারী উভয়ের গুনাহ সমান। তাই সর্বদা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।(আরো বিস্তারিত জানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯৯৭৩৭) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: