যিলহজ্জ ও কুরবানীর ধারাবাহিক ১৩ তম পর্ব।
প্রশ্ন: কোন ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী দেয়া বৈধ? পশু কুরবানী করার সঠিক পদ্ধতি কি? মাংস কিভাবে বন্টন করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
➤ভূমিকা: আরবী যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা। এটা মুসলিম সমাজে কুরবানীর ঈদ নামেও পরিচিত। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে পরিচিত। ভারত ও পাকিস্তানে এটাকে ‘বকরী ঈদ’ বলা হয়ে থাকে।আরবী ‘কুরবান’ (قربان) শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে,যার অর্থ ‘নৈকট্য।পারিভাষিক অর্থে:আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় উৎসর্গকৃত পশু কিংবা অন্য যে কোনো কিছুকে আরবীতে ‘কুরবান’ বলা হয়।সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামের অন্যতম ইবাদত হলো এ কুরবানী। পূর্ববর্তী নবীগণের উপরও এ বিধান চালু ছিল। আল্লাহ বলেন,আমি প্রত্যেক জাতির উপর কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম’ (আল-হাজ্জ, ২২/৩৪)।কুরবানীর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব ইতিহাসে প্রথম কুরবানী অনুষ্ঠিত হয়েছিল আদম আঃ-এর পুত্র হাবীল ও কাবীলের মাধ্যমে। হাবীলের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠার কারণে তার কুরবানী আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছিল। অপরদিকে কাবীলের অনাগ্রহ ও নিষ্ঠাহীনতার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল (আল-মায়েদা, ৫/২৭)।কুরবানী আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এতে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাত আদায়ের সাথে সাথে প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতও পালন করা হয়। কেননা তিনি নিজে কুরবানী করেছেন এবং তাঁর উম্মতের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে অবশিষ্ট রেখে গেছেন। ফলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কুরবানীর বিধান বলবৎ থাকবে ইনশাআল্লাহ। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক। তাই এর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একান্ত দায়িত্ব।
◾➤কুরবানীর উদ্দেশ্য :কুরবানী করা একটি মহান ইবাদাত।কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা।কুরবানী হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। কে কত বড় কুরবানী দিল, কার কুরবানী দেখতে কত সুন্দর, কতটা মোটাতাজা, এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দেখেন না। বরং তিনি দেখেন মানুষের অন্তর ও তাক্বওয়া।মহান আল্লাহ বলেন, এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া’ (সূরা হজ্জ, ৩৭)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ছা.) বলেছেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক গঠন ও বিত্ত-বৈভবের দিকে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল’।(সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪)
◾➤কুরবানীর পশু :কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেণী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। আর নির্ধারিত শ্রেণীর পশু চারটি; উঁট, গরু, ভেঁড়া ও ছাগল। অধিকাংশ উলামাদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানী হল উঁট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেঁড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে।(আযওয়াউল বায়ান ৫/৬৩৪) এগুলোর বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না। তবে অনেক বিদ্বান মহিষকে গরুর অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয বলেছেন।[সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪-৪৫; মির‘আতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৮১)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘উপরে বর্ণিত পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না’।[কিতাবুল উম্ম (বৈরূত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ২/২২৩ পৃ. ]
.
◾➤কুরবানীর পশুর বয়সঃ যেকোনো রঙের পশু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ,তবে কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম।বয়সের দিক দিয়ে উঁটের পাঁচ বছর, গরুর দুই বছর এবং মেষ ও ছাগলের এক বছর হওয়া জরুরী। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘দাঁতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্লভ হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’’(সহীহ মুসলিম ১৯৬৩) উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক।(সহীহ বুখারী ২১৭৮, মুসলিম ১৯৬৫)
.
◾➤যেসকল পশু দ্বারা কুরবানী করা নাজায়েজ:
কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যেমন- (১)
স্পষ্ট খোঁড়া, (২)স্পষ্ট কানা,(৩)স্পষ্ট রোগী ও জীর্ণশীর্ণ এবং (৪)অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা ও অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।[আহমাদ হা/১৮৬৯৭, ১০৪৮, ১০৬১; তিরমিযী হা/১৪৯৭; ইবনু মাজাহ হা/৩১৪৪ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) ২/৩০ পৃ.)
উপরে বর্ণিত চার প্রকার পশুর চাইতে নিম্নস্তরের কোন দোষ যেমন অর্ধেক লেজ কাটা ইত্যাদি থাকলে তার দ্বারাও কুরবানী হবে না। তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহ’লে ঐ পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে।[মির‘আত ২/৩৬৩; ঐ, ৫/৯৯ পৃ.) উল্লেখ্য যে, খাসি করা কোন খুঁৎ নয়। বরং এতে পাঁঠা ছাগলের দুর্গন্ধ দূর হয় এবং গোশত রুচিকর হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে দু’টি মোটাতাজা খাসি দিয়ে কুরবানী করেছেন।[ইবনু মাজাহ হা/৩১২২; ইরওয়া হা/১১৩৮, ৪/৩৫১ পৃ.; মিশকাত হা/১৪৬১)
.
◾➤কুরবানী করার পদ্ধতি : উট অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়), তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘সুতরাং দন্ডায়মান অবস্থায় ওদের যবেহকালে তোমরা আল্লাহর নাম নাও।’’(সূরা হজ্জ:ন ২২/৩৬)
মোটকথা উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়।যেহেতু তা সহজ এবং ডান হাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। তবে যদি যবেহকারী নেটা বা বেঁয়ো হয় তাহলে সে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করতে পারে। যেহেতু সহজ উপায়ে যবেহ করা ও পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্য।
পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা মুচড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।(সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃ. ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ পৃ.)
কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে তাড়াতাড়ি পশু জবাই করবে যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবেহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। যদি যবেহকারী ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে যান, তাহ’লেও কোন দোষ বর্তাবে না ইনশাআল্লাহ।কেননা কেবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই।(শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ২/২২৩ পৃ. আহকামুল উযহিয়্যাহ ৮৮,৯৫পৃঃ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে কুরবানী যবেহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবেহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। হাকেম ও বায়হাক্বীর একটি যঈফ সূত্র অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ মর্মে কন্যা ফাতেমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।(মির‘আত ২/৩৫০ পৃ. ; ঐ, ৫/৭৪ পৃ.)
◾➤কুরবানীর পশু যবেহকালীন দো‘আ: আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যবেহ করার সময় বলেছেন, بِسْمِ اللّٰهِ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ
উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্ল-হু আকবার’।অর্থ : আল্লাহর নামে (যবেহ) করছি, আল্লাহ মহান। (ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬৫;সহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৬; মিশকাত, হা/১৪৫৩)।এর সাথে ‘আল্ল-হুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্নী’ও বলা যাবে।(সহীহ মুসলিম, হা/১৯৬৭; আলবানী, মানাসিকুল হাজ্জ, পৃ. ৩৫)। অতএব (কুরবানী কেবল নিজের তরফ থেকে হলে) বলবে, ‘বিসমিল্লাহি অল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা অলাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্নী।’নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে,‘—তাক্বাব্বাল মিন্নী অমিন আহলে বাইতী।’ অপরের নামে হলে বলবে, ‘—তাক্বাব্বাল মিন (এখানে যার তরফ থেকে কুরবানী তার নাম নেবে)(মানাসিকুল হাজ্জ, আলবানী ৩৬পৃঃ) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।(ইবনু কুদামা, আল-মুগনী (বৈরূত ছাপাঃ তারিখ বিহীন) ১১/১১৭ পৃ.)
প্রকাশ যে, পশু যবেহর পর পঠনীয় কোন দুআ নেই।
.
▪️পশুকে কষ্ট না দিয়ে জবাই করা :কুরবানীসহ যে কোনো পশু জবাই করার সময় লক্ষ রাখতে হবে, পশু যেন কষ্ট না পায় এবং সহজেই সে প্রাণত্যাগ করতে পারে।এর জন্য জবাইয়ের ছুরিকে উত্তমরূপে ধার দিয়ে নিতে হবে পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে হবে।শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.)বলেছেন,‘আল্লাহ সবকিছুর উপর দয়া করা অপরিহার্য করে দিয়েছেন। সুতরাং যখন হত্যা করবে, তখন উত্তমভাবে হত্যা করো। যখন (পশু-প্রাণী) জবাই করবে, তখন উত্তমভাবে জবাই করো। আর প্রত্যেকে যেন ছুরিতে ধার দিয়ে নেয় এবং জবাইয়ের পশুকে শান্তি দেয়’।[সহীহ মুসলিম, হা/১৯৫৫; মিশকাত, হা/৪০৭৩।।
◾➤আরো কিছু বিষয় লক্ষনীয়ঃ
_______________________________
➤(১). যবেহতে খুন বহা জরুরী। আর তা দুই শাহরগ (কন্ঠনালীর দুই পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যা খুন বহায়, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর। তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়।’(আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ) সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরী; শক্ষাসনালী, খাদ্যনালী এবং পাশর্ক্ষস্থ দুই মোটা শিরা।
➤(২). প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। অনুরূপভাবে দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যেহেতু অন্যভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
➤(৩).পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।
➤(৪).যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
➤(৫).যবেহ করে ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবেহ করা যায়। নতুবা কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে, আর তা হালাল।
➤(৬).প্রকাশ থাকে যে, যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা যবেহকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরী। সুতরাং কাফের, মুশরিক (মাযার বা কবরপূজারী) ও বেনামাযীর হাতে যবেহ শুদ্ধ নয়।
➤(৭).পাশাপাশি যবেহ করার আগে কুরবানীর পশুকে গোসল দেওয়া, তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়ায করা বিদআত।উল্লেখ্য যে, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করা বৈধ নয়।( বই কুরবানীর বিধান আব্দুল হামিদ ফাইজি মাদানি)
◾➤কুরবানীর গোশত বন্টন : কুরবানীর গোশত তিন শ্রেণীর মানুষ খাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,তা হতে তোমরা খাও, অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও এবং ভিক্ষাকারীকে দাও’(সূরা আল-হজ্জ : ৩৬)। তাই তিন ভাগ করা ভাল। তবে প্রয়োজনে ভাগে কম-বেশিও করা যাবে এবং সবটুকুও ছাদাক্বাহ করা যাবে। কিন্তু কাউকে না দিয়ে একাই খাওয়া জায়েয নয়। দরিদ্র ও মিসকীনদের জন্য জমাকৃত গোশত যারা কুরবানী দিয়েছে তাদের মাঝে বণ্টন করা ঠিক নয়। উল্লেখ্য যে, ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহ আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন ও একভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ সায়েলদের তথা ভিক্ষুকদের মধ্যে ছাদাক্বাহ করতেন’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি সনদ বিহীন।[ আলবানী, ইরওয়াউল গালীল, হা/১১৬০; মির‘আত, হা/১৪৯৩, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১২০ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৪৪; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১০৮-০৯।
◾➤কুরবনাীর গোশত সংরক্ষণ : কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। এমনকি ‘এক যুলহিজ্জাহ থেকে আরেক যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত’ এক বছর।(আহমাদ হা/২৬৪৫৮ ‘সনদ হাসান’ তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪১৩)তবে মহল্লায় অভাবীর সংখ্যা বেশী থাকলে বা দেশে ব্যাপক অভাব দেখা দিলে তিনদিনের পর গোশত সবটুকু বিতরণ করা যরূরী।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, নায়ল ৬/২৫২ পৃ. ; তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪০৯, ৪৪১২ প্রভৃতি।
◾➤একনজরে পশু কুরবানী করা সংক্রান্ত কয়েকটি মাসয়ালা:
__________________________________
➤(১) ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।(মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৪৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃ. নায়লুল আওত্বার ৬/২৫৩)তবে অনেক সাহাবী, ইমাম শাফেঈ ও বহু বিদ্বানের মতে ঈদুল আযহার পরের তিনদিন কুরবানী করা যাবে। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী এটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।(ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাদাবীহ ৫/১০৬-০৯ পৃ.)
➤(২).দিনে রাতে যে কোন সময় কুরবানী করা জায়েজ। অনেকে সন্ধ্যার পরে কুরবানী করা নাজায়েয মনে করেন। এটা ঠিক নয়।বরং রাতেও কুরবানী করা যায় তবে উত্তম হল দিনে করা।
➤(৩).কুরবানীর পশু যবেহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা হ’তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না।সাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী দিতেন।(মুসলিম হা/১৩১৭; বুখারী হা/১৭১৭; মিশকাত হা/২৬৩৮)অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।(বুঃ মুঃ মিশকাত হা/২৬৩৮; মির‘আত হা/২৬৬২-এর আলোচনা, ৯/২৩০ পৃ.)
➤(৪) কুরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ। তবে তার চামড়া বিক্রি করা জায়েজ। চামড়া বিক্রি করে শরী‘আত নির্দেশিত সাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (সূরা তওবা ৬০)। এগুলি মহল্লায় বায়তুল মাল ফান্ডে জমা করে আল্লাহভীরু বিশ্বস্ত মুতাওয়াল্লীর মাধ্যমে সুশৃংখল ভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার সাথে ব্যয় করা উত্তম। আজকাল বড় বড় শহরে পেশাদার ভিক্ষুক ও তাদের সহযোগীদের দেখা যায় অনেক পরিমাণ কুরবানীর গোশত সংগ্রহ করে তা পরে কম দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের দুষ্কর্ম থেকে এখুনি তওবা করা উচিত। মনে রাখা ভাল যে, আল্লাহর ন্যায় বিচারে ধনী-গরীব কেউ ছাড় পাবে না। (বিস্তারিত মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আহমাদ, নায়ল ৬/২৫৫-৫৬; মির‘আত ৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃ.
➤(৫) কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করা নাজায়েয। আল্লাহর রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।(মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৩০৪; মুগনী, ১১/৯৪-৯৫ পৃ.)
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী সাদাক্বার চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের সালাত অন্য সকল নফল সালাতের চাইতে উত্তম।(তাফসীরে কুরতুবী (সূরা ছাফফাত ৩৭/১০২), ১৫/১০৮ পৃ. ।মির‘আত, ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬।
➤(৬)কুরবানীর মাংস অমুসলিম দরিদ্র প্রতিবেশীকেও দেওয়া যায় (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮)।ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৪২৪)। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত নফল সাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত (আল-মুগনী ৩/৫৮৩, ৯/৪৫০)।
➤(৭).কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে।এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়।(বাইহাকী ৯/২৮৮, আল-মুমতে ৭/৫১০)
উপসংহার،আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরবানীর সকল মাসআলা-মাসায়েল বিশুদ্ধভাবে জানা ও সে অনুযায়ী পালন করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।