প্রশ্ন: পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, যারা জাহান্নামে যাবে তারা সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে।আবার হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ একনিষ্ঠ ভাবে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়ে মৃত্যু বরন করবে সে পাপী হলেও পাপের শাস্তি ভোগ করে কোন একদিন আল্লাহর ক্ষমায় জান্নাতে যাবে? তাহলে কি এই হাদীসটি কুরআনের ঐ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
একটি বিষয় জানা উচিত যে, ইসলামী শরী‘আতের প্রধান উৎস দু’টি তা হল: পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীস,যা মুসলিম মিল্লাতের মূল সম্পদ। প্রত্যেক মুসলিমের জানা আবশ্যক যে, কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীস দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার ওহী। উভয়ের উপর সমানভাবে ঈমান আনয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কুরআনকে বলা হয় অহিয়ে মাতলূ, যা পাঠ করা হয়। আর হাদীসকে বলা হয় অহিয়ে গায়রে মাতলূ। দু’টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বিধান। (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম হাদীসকে আল্লাহ প্রেরিত ‘ওহী’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৭৩১০; মিশকাত, হা/১৭৫৩)। তাই হাদীসের প্রতি আমল না করে কেউ মুমিন হতে পারে না। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমকে হাদীস ও তার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া অপরিহার্য। (সূরা আলি ‘ইমরান : ৩১; সূরা আন-নিসা : ৬৫, ৮০; সূরা আল-হাশর :৭)।আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত মতানুযায়ী আহলে কুরআন বা হাদীস অস্বীকারকারীরা কাফির। (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯, ফৎওয়া নং-১১৫১২৫ আল-ওয়াসিয়্যাতুল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৫ ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৪ ও ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২০)।
.
এবার আসি মূল কথায়, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা) এর সহীহ কোন হাদীস কখনোই পারস্পরিক সাংঘর্ষিক নয়, বরং দু’টিই স্ব-স্ব স্থানে সঠিক, প্রাসঙ্গিক এবং একে অপরের পরিপূরক। সাধারণত আল্লাহ যত জায়গায় خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ‘তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে’ বলেছেন, তার প্রায় জায়গাতেই কাফির, মুশরিক অথবা মুনাফিকদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর যারা কুফরী করবে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করবে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। কত মন্দ ঐ প্রত্যাবর্তনস্থল!’ (সূরা আত-তাগাবূন : ১০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের আগুনের মধ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম।’ (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৬)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটা তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি।’ (সূরা আত-তওবাহ: ৬৮)। এছাড়াও সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৬১-১৬২, ১৬৭; সূরা আলে ‘ইমরান: ৮৮; সূরা আন-নিসা: ১৬৯; সূরা আল-মায়িদাহ: ৩৭; সূরা আল-নাহল: ২৮-২৯; সূরা আয-যুমার: ৭২; সূরা আল-গাফির: ৭৬; সূরা আল-হাশর: ১৭ এবং সূরা আল-জিন: ২৩ আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
◾পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখিত চিরস্থায়ী’ জাহান্নামী পরিভাষাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের বিদ্বানগণ দু’ভাগে ভাগ করেছেন।
____________________________________
▪️(১) পবিত্র কুরআন বা সহীহ হাদীসে অমুসলিম কাফিরদের ক্ষেত্রে যখন চিরস্থায়ী পরিভাষা ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হবে সীমাহীন।
▪️(২) যখন তাওহীদবাদী পাপাচারীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে তার অর্থ হবে সীমাবদ্ধ। কারণ শিরককারী ব্যতীত অন্য কোন কবীরা গুনাহগার ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না,যা কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
.
প্রিয় নবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মধ্যে যাদের ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে তারা হল-পাপী মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ ‘মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহীহ বুখারী, হা/৩০৬২, ৪২০৩-৪২০৪, ৬৬০৬;সহীহ মুসলিম, হা/১১১, ২০৫)।
.
অন্তর থেকে একনিষ্ঠভাবে তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তার পাপের শাস্তি দেওয়ার পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,আমার শাফা‘আত প্রাপ্ত সবচাইতে সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে খালেছ অন্তরে বলেছে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’ (সহীহ বুখারী হা/৯৯; মিশকাত হা/৫৫৭৪)।
.
অপর হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘এবং আমার উম্মতের অবশিষ্ট লোকদের জাহান্নামীদের সঙ্গে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। অতঃপর জাহান্নামবাসীরা বলবে, ‘তোমরা যে আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করতে না, আজ তা তোমাদের কোন উপকার করতে পারল না। একথা শুনে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘আমার সম্মানের কসম, আমি অবশ্যই তাদের জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবো। সুতরাং তাদের জাহান্নাম থেকে এমতাবস্থায় বের করা হবে যে,তারা জ্বলে-পুড়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তাদের আবে-হায়াত (জীবন) নামক নদীতে প্রবেশ করানো হবে, ফলত স্রোতবাহিত উর্বর পলিতে গজিয়ে উঠা শস্য দানার ন্যায় তারা সজীব হয়ে উঠবে। তাদের ললাটে লিখে দেয়া হবে, ‘এরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল। অতঃপর তাদের নিয়ে গিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। জান্নাতবাসীগণ তাদের জাহান্নামবাসী বলে সম্মোধন করলে, আল্লাহ বলবেন ‘বরং এরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪৬৯-১২৪৭০; ইবনু খুযাইমা, হা/৬০১; দারেমী, হা/৩৫; ইবনু মানদাহ, হা/৮৭৭, সনদ হাসান)।
.
অন্যত্র নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কতকগুলো সম্প্রদায় তাদের গুনাহের কারণে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। অতঃপর আল্লাহ নিজ রহমতে তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাদেরকে ‘জাহান্নামী’ বলা হবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/৬৫৫৯, ৬৫৬৬, ৭৪৫০)।
.
এছাড়াও কুরআনের অন্যান্য আয়াত ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে উক্ত চিরস্থায়ী শাস্তির ঘোষণাকে ধমক বলে মানতে হবে। অর্থাৎ, কোন মুসলিমের বুকে যদি তাওহীদ থাকে, তাহলে সে একদিন না একদিন মুক্তি পাবে; যদিও শাস্তি ভোগার পরে। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃনবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন-একদা জিবরীল (আঃ) আমার নিকট এসে সুসংবাদ দিলেন যে,আপনার উম্মাতের যে কেউ শিরক না করে মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি (আবূ যার) বললাম, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং যদিও সে চুরি করে। তিনি বললেন, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে। (সহীহ বুখারী ৬২৬৮, ৬৪৪৪,৩২২২ সহিহ মুসলিম,হাদিস নং ১৭৩ ই.ফা. ১৭৪; ই.সে. ১৮০)।
.
আহলে সুন্নাহর অন্যতম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল মুসলিম পাপাচারীরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না, যেমনটি খারেজী ও মু‘তাযিলারা ধারণা করে থাকেন।’ (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৭/৬৭৯)।
◾কুরআন সুন্নাহর আলোকে একনজরে চিরস্থায়ী জাহান্নামী ব্যক্তিদের তালিকা। যেমন:
(১). কাফির।
(২). মুশরিক।
(৩). মুনাফিক (আকীদাগত)।
(৪). মুরতাদ (দ্বীন ত্যাগী)।
(৫). কুরআনের কিছু বা একটি হলেও আয়াতকে সরাসরি মিথ্যারোপকারী।
(৬). আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতাকারী।
(৭). শেষ নবী হিসাবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অস্বীকারকারী।
.
এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, এভাবে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের পরিণাম দুঃখজনকভাবে প্রদর্শন করবেন এবং তারা জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।’ (সূরা আল-বাক্বারা: ১৬৭)।
.
নিশ্চয় তারা এটা কামনা করবে যে, জাহান্নাম থেকে বের হয়ে যায়, অথচ তারা তা থেকে কখনও বের হতে পারবে না। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি।’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৩৭)।
.
মহান আল্লাহ আরো বলেন, আর যারা কুফরী করেছে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। (সূরা বাকারাঃ৩৯)।মুফাস্সিরগণ উক্ত আয়াতগুলো কাফিরদের ব্যাপারে বলে উল্লেখ করেছেন। (তাফসীরে ত্বাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯৯)।
.
এছাড়া অনেক সহীহ হাদীসে জাহান্নামীদের চিরস্থায়ী শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যেমন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আর যারা জাহান্নামবাসী হিসেবে সেখানকার অধিবাসী হবে, তারা সেখানে মরবেও না বাঁচবেও না।” (সহীহ মুসলিম: ১৮৫)।
.
অপর বর্ননায় এসেছে, মৃত্যুকে সাদা-কালো মিশ্রিত রংয়ের একটি দুম্বার আকৃতিতে হাযির করে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে যবেহ করা হবে। অতঃপর বলা হবে, হে জান্নাতবাসীগণ! মৃত্যুহীন স্থায়ী জীবন যাপন করো। হে জাহান্নামীরা! মৃত্যুহীন স্থায়ী জীবন যাপন করো। (বুখারী হা/৪৭৩০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৮৪৯)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।