পশ্চিম (কিবলা) দিকে পা করে বসা কিংবা ঘুমানো নিষিদ্ধ মর্মে কুরআন সুন্নাহতে এমন কোন বিশুদ্ধ দলিল আছে বলে আমাদের জানা নাই। আর ইসলামে দলীল বিহীন কোন কিছুকে উত্তম, হারাম কিংবা মাকরূহ বলার সুযোগ নেই। যদিও হানাফী মাযহাবের কোন কোন আলেম ঘুমের সময় বা অন্যান্য সময় কিবলার দিকে পা রাখাকে মাকরূহ (অপছন্দনীয়) বলেছেন। কিন্তু এগুলো দলীল বহির্ভূত কথা। কারন কোন কিছুকে মাকরূহ বলতে হলেও তার পক্ষে শারঈ দলীল লাগবে,কেবল যুক্তি দিয়ে শারঈ হুকুম সাব্যস্ত করা যায় না। তাছাড়া হানাফী মাযহাব ছাড়া বাকি তিন (শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী) মাযহাবের কোন ইমামগণই এটিকে মাকরূহ বলেননি। সুতরাং এ ব্যাপারে হানাফি আলেমদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বরং বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে,ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মানুষ স্বাধীনভাবে যে দিকে ইচ্ছা মাথা বা পা রেখে বসতে পারে এমনকি কিবলার দিকে পা করে ঘুমাতেও কোন দোষ নেই-যদি না! উদ্দেশ্য থাকে কিবলাকে অসম্মান করা।আর কেউ যদি কিবলাকে অবজ্ঞা/অসম্মান করার উদ্দেশ্য এমনটি করে তবে তা মারাত্মক গুনাহের কাজ তাতে কোন সন্দেহ নাই।কারন মক্কার কাবা আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম বিশেষ একটি নিদর্শন। আর আল্লাহ তাআলার নিদর্শনগুলোকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করা মানুষের উপর আবশ্যক।মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَكَّۃَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ “নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত।তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের জন্য পথের দিশারী”।(সূরা আলে ইমরান: ৯৬) আয়াতে (وُضِعَ لِلنَّاسِ) শব্দের মাধ্যমে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র মানবগোষ্ঠী এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। আল্লাহ্ তা’আলা এর প্রকৃতিতে এমন মাহাত্ম্য নিহিত রেখেছেন যে,মানুষের অন্তর আপনা-আপনিই এর দিকে আকৃষ্ট হয়।
.
অতএব কাবা শরীফের মানহানীর নিয়ত ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে কিবলার দিকে পা রেখে ঘুমানোর ব্যাপারে ইসলামে কোন ধরণের নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি। তবে হা! রাসূল (ﷺ) খোলা স্থানে পেশাব-পায়খানা করার সময় কিবলাকে সামনে বা পেছনে রাখতে নিষেধ করেছেন। যেমন আবূ আইয়ূব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:إِذَا أَتَيْتُمُ الْغَائِطَ فَلَا تَسْتَقْبِلُوا الْقِبْلَةَ وَلَا تَسْتَدْبِرُوهَا وَلَكِنْ شَرِّقُوا أَوْ غَرِّبُوا “তোমরা যখন পায়খানায় যাবে তখন ক্বিবলা (কিবলা/কেবলা) কে সামনে বা পেছনে রেখে বসবে না, বরং পূর্বদিকে ফিরে বসবে অথবা পশ্চিম দিকে। (সহীহ বুখারী হা/ ৩৯৪; সহীহ মুসলিম হা/২৬৪) হাদীসের ব্যাখায় শায়খ ইমাম মুহয়্যিইউস সুন্নাহ্ বলেছেন এটা উন্মুক্ত প্রান্তরের হুকুম। দালান-কোঠা বা ঘরের মধ্যকার পায়খানায় অথবা ঘরের মতো করে নির্মিত পায়খানায় এরূপ করা দোষের নয়। আর (وَلكِنْ شَرِّقُوْا أَوْ غَرِّبُوْا) তোমরা পূর্ব পশ্চিম দিকে মুখ করে পেশাব-পায়খানা কর। এ আদেশটি মূলত মদীনাবাসী এবং যাদের ক্বিবলাহ মদীনাবাসীদের ক্বিবলার দিকে তাদের জন্য প্রযোজ্য। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যে, দিকাভিমুখী হলে ক্বিবলাহ সামনে বা পেছনে হয় না সেদিকে মুখ করে স্বাভাবিক প্রয়োজন (তথা পেশাব-পায়খানা) পূরণ করা যা দেশভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। (অর্থাৎ- প্রত্যেক দেশের অধিবাসীরা সেদিকে মুখ করে স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ করবে যে দিকাভিমুখী হবে (ক্বিবলাহ্ সামনে বা পেছনে হবে না)। তবে প্রস্রাব পায়খানা করার স্থান চারিদিকে ঘেরা থাকলে কোন অসুবিধা নেই। যেমন মারওয়ান আল-আছফার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে ক্বিবলার দিকে উট বসিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে বসে পেশাব করতে দেখলাম। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আব্দুর রহমান! কিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে কি নিষেধ নেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এ নিষেধাজ্ঞা ফাঁকা জায়গার জন্য প্রযোজ্য। যদি তোমার ও ক্বিবলার মধ্যে কোন বস্তু দ্বারা আড়াল করা হয়, তবে কোন অসুবিধা নেই’ (আবূ দাঊদ হা/১১,সনদ হাসান)। আরেক বর্ননায় ইবনু ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لَقَدِ ارْتَقَيْتُ يَوْمًا عَلَى ظَهْرِ بَيْتٍ لَنَا فَرَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى لَبِنَتَيْنِ مُسْتَقْبِلًا بَيْتَ الْمَقْدِسِ لِحَاجَتِهِ ‘আমি হাফছার বাড়ীর ছাদে কোন কারণে উঠেছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ক্বিবলা বায়তুল মাক্বদিসের দিকে পিঠ করে দু’টি ইটের উপর হাজত সারতে দেখলাম” (সহীহ বুখারী, হা/১৪৮, ৩১০২; মিশকাত, হা/৩৩৫)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হিজরী./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,
لا حرج في ذلك، لا بأس أن يمد الإنسان رجله إلى جهة القبلة، حتى ولو كان في المسجد الحرام إلى جهة الكعبة،لا حرج،قد جلس النبي ﷺ وأسند ظهره إلى الكعبة، عليه الصلاة والسلام.فالمقصود:أنه لا حرج كون الإنسان يمد رجله إلى جهة الكعبة، إلى جهة القبلة،لا حرج في ذلك
“এক্ষেত্রে (কিবলা অভিমুখী করে পা রাখা) কোনো অসুবিধা নেই। একজন মানুষের কিবলা অভিমুখী করে পা রাখাতে কোন সমস্যা নেই। এমনকি যদিও সে মাসজিদুল হারামের মধ্যে কিবলা অভিমুখী করে; এতে কোন অসুবিধা নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার দিকে তার পিঠ হেলান দিয়ে বসেছেন। তাই মূল কথা হলো একজন মানুষের কা‘বা অর্থাৎ কিবলা অভিমুখী করে পা রাখাতে কোন অসুবিধা নেই। ফলে এক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই”।[বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতাওয়া নং ১৫৩৫৪]
.
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হিজরী./২০০১ খ্রিস্টাব্দ] তিনি বলেছেন,
“ليس على الإنسان حرج إذا نام ورجلاه اتجاه الكعبة بل إن الفقهاء رحمهم الله يقولون:إن المريض الذي لا يستطيع القيام ولا القعود يصلي على جنبه ووجهه إلى القبلة،فإن لم يستطع صلى مستلقياً ورجلاه إلى القبلة”
“কিবলার দিকে পা দিয়ে ঘুমাতে কোন দোষ নেই। বরং ফিকাহবিশারদগণ বলেন যদি কোন অসুস্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বা বসে নামায পড়তে না পারে তাহলে কিবলা মুখ করে এক পাশে শুয়ে নামায আদায় করবে। যদি সেটাও না পারে তাহলে চিত হয়ে শুয়ে কিবলার দিকে পা দিয়ে নামায পড়বে”।(ইবনু উসাইমীন মাজমা’উ ফাতাওয়া খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৯৭৬; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং: ২০৯৪৩)
.
শাইখ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে কিবলা অভিমুখী করে পা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
لا مانع منه،إلا أن بعض العلماء يكره أن يمد رجليه نحو الكعبة إذا كان قريباً منها،فكره ذلك كراهة تنزيهية.أما مثل وجود مسجد في مكان آخر وفيه مسلم يوجه رجليه نحو القبلة، فهذا لا بأس به،ولا محظور فيه إن شاء الله،كما قرره أهل العلم .والله أعلم
“এতে কোন বাধা নেই। তবে কতিপয় আলেম কা‘বার দিকে কা‘বার নিকটবর্তী থাকাকালীন দু-পা সম্প্রসারণ করা (বাড়িয়ে দেওয়া) অপছন্দ করেছেন। যদি এটি কাবার নিকটবর্তী হয় তবে এটি মাকরূহ তানযিহ (অর্থাৎ এই কাজ থেকে বিরত থাকা উত্তম। তাই বলে একে হারাম বলা যাবে না)। অতঃপর কা‘বা ব্যতীত অন্য যে কোন স্থানে থাকা মসজিদের মধ্যে কোন মুসলিম যদি কিবলার দিকে তার দু-পা অভিমুখী করে; তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই এবং ইনশাআল্লাহ এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি। যেমনটি আহালুল ইলমগণ এ সম্পর্কে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। (আল্লাহ তাআলা অধিক অবগত)।(ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে হামিদ, পৃষ্ঠা: ১৪৪)
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র ইত্যাদিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সালাফী বা আহলুল হাদীস হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং এই বিজয় কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন। আমীন!(আল্লাহই ভাল যানেন)।
______________________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:) শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।