প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির আমলনামায় সওয়াব পাঠানোর জন্য করণীয় আমলগুলো কি? অর্থাৎ যে সকল কর্মের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয় বিস্তারিত বর্ননাসহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬

▬▬▬▬▬▬▬▬



➤ভূমিকা:প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি। অতএব তোমার মৃত্যু হ’লে তারা কি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে? জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর আমরা তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’(আম্বিয়া ২১/৩৪-৩৫)। তিনি আরো বলেন, ‘যে মৃত্যু হ’তে তোমরা পলায়ন করছ তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। তারপর তোমাদেরকে অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্পর্কে পরিজ্ঞাত আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’(জুমু‘আ ৬২/৮)। সুতরাং সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও মৃত্যু কাউকে ছাড় দিবে না।’(সূরা নিসা ৪/৭৮)। রাসূল (ﷺ)বলেন-মৃত্যু সত্য, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য।’(মুত্তাফাক আলাইহ্, মিশকাত হা/১২১১)। নবী-রাসূল ও রাজা-বাদশাহ সকলকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। মৃত্যু থেকে কেউ রেহাই পাবে না। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে দেখতে আসা সাহাবীগণ বললেন, আমরা কি আপনার জন্য ডাক্তার আনব না? জওয়াবে তিনি বললেন, তিনি আমাকে দেখেছেন।সাহাবীগণ বললেন, তিনি আপনাকে কি বলেছেন? জবাবে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেন, তিনি (আল্লাহ) বলেছেন যে, আমি যা চাই তাই করি।’(কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের ইহকালীন জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। পরকালীন যাত্রা পথের প্রথম মনযিল হচ্ছে ‘কবর’। কবরে মানুষকে পৃথিবীর কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী মানুষ সঠিক ও সুন্দর উত্তর দিবে। ফলে তার কবর শান্তিময় হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তি উত্তর দিতে পারবে না। ফলে তার কবর ভয়াবহ শাস্তির স্থলে পরিণত হবে।এভাবে উভয় শ্রেণীর মানুষই ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত কবরে অবস্থান করবে।

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

➤ (১) সাদাক্বায়ে জারিয়াহ। (যেমন:মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা,রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, অনাবাদী জমিকে আবাদকরণ,সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল স্থাপন বই ক্রয় করে বা ছাপিয়ে বিতরণ,বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি)।
➤ (২) ইলম, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। (যা মানুষকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও সহীহ সুন্নাহর পথ দেখায় এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত হতে বিরত রাখে। উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শিক্ষাদান করা,ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে সহযোগিতা প্রদান,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল সম্পন্ন বই-প্রবন্ধ লেখা, ছাপানো ও বিতরণ করা এবং এজন্য অন্যান্য স্থায়ী প্রচার মাধ্যম স্থাপন ও পরিচালনা করা ইত্যাদি)।
➤ (৩) সুসন্তান,যে তার জন্য দো‘আ করে’। (মৃতের জন্য সর্বোত্তম হাদিয়া হ’ল সুসন্তান,যে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে,সাদাক্বা করে,তার পক্ষ হ’তে হজ্জ করে ইত্যাদি)।(সহীহ মুসলিম হা/১৬৩১, মিশকাত হা/২০৩)
.

➤(১) তাদের জন্য দো‘আ করা,
➤(২) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা,
➤(৩) তাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ পূর্ণ করা
➤(৪) তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা, যারা তাদের মাধ্যমে তোমারও আত্মীয়।
➤(৫) তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা’।
(আবূদাঊদ হা/৫১৪২; মিশকাত হা/৪৯৩৬; ইবনু হিববান হা/৪১৮, ইবনু হিববান, হাকেম, যাহাবী, হুসাইন সুলাইম আসাদ এর সনদকে ছহীহ ও জাইয়েদ বলেছেন।হাকেম হা/৭২৬০; মাওয়ারিদুয যাম‘আন হা/২০৩০)। তবে শায়খ আলবানী ও শু‘আইব আরনাউত্ব যঈফ বলেছেন। কিন্তু এর সনদ যঈফ হ’লেও মর্ম সহীহ।
উপরোক্ত হাদীসে পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি সদাচরণের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর করণীয় হ’ল-তাদের জানাযার সালাত আদায় করা,তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করা,তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের প্রিয় মানুষদের শ্রদ্ধা করা।সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য জানাযার সালাত অথবা দো‘আ করা। হানাফী বিদ্বান আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন,সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল তাদের জন্য আল্লাহর রহমতের দো‘আ করা। ইসতেগফার দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করা অর্থ হ’ল তাদের অসিয়ত বাস্তবায়ন করা। তাদের কারণে সৃষ্ট আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার অর্থ হ’ল নিকটাত্মীয়ের প্রতি ইহ্সান করা।(মিরক্বাত হা/৪৯৩৬-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.

➤(১) দ্বীনী ইলম শিক্ষা দান করা
➤(২) নদী-নালা প্রবাহিত করা
➤(৩) কূপ খনন করা
➤৪) খেজুর তথা ফলবান বৃক্ষ রোপণ করা
➤(৫) মসজিদ নির্মাণ করা
➤(৬) কুরআন বিতরণ করা
➤(৭) এমন সন্তান রেখে যাওয়া, যে পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’(মুসনাদ বাযযার হা/৭২৮৯; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান;সহীহুল জামে‘ হা/৩৬০২)। এটি পূর্বের হাদীসের ব্যাখ্যা স্বরূপ।
.

➤(১)সেই ইলম, যা সে শিক্ষা করে প্রচার করেছে
➤(২)অথবা নেক সন্তান যাকে রেখে সে মারা গেছে
➤(৩) অথবা কুরআন মজীদ যা সে মীরাছরূপে ছেড়ে গেছে
➤(৪)অথবা মসজিদ যা সে নিজে নির্মাণ করে গেছে
➤(৫)অথবা মুসাফিরখানা যা সে মুসাফিরদের সুবিধার্থে নির্মাণ করে গেছে
➤(৬)অথবা পানির নালা যা সে (সেচ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে) প্রবাহিত করে গেছে
➤(৭)অথবা সাদাক্বাহ যা সে নিজের মাল থেকে তার সুস্থ ও জীবিতাবস্থায় বের (দান) করে গেছে। এসব কর্মের সওয়াব তার মৃত্যুর পরও তার সাথে এসে মিলিত হবে’।(ইবনু মাজাহ হা/২৪২; মিশকাত হা/২৫৪; ছহীহুত তারগীব হা/৭৭, ১১২)
.

➤(১).আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত প্রহরা,
➤(২).ব্যক্তির এমন (মাসনূন) আমল যা অন্যেরাও অনুসরণ করে,
➤(৩). এমন সাদাক্বাহ যা সে স্থায়ীভাবে জারী করে দিয়েছে,
➤(৪). এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়া যে তার জন্য দো‘আ করে’।(আহমাদ হা/২২৩০১; ছহীহুত তারগীব হা/১১৪)
উল্লেখ্য যে,সৎ সন্তান দো‘আ না করলেও তার সৎ কর্মের সওয়াব পিতা-মাতা পাবেন বলে একদল বিদ্বান উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় অভিমত ব্যক্ত করেছেন।(আলবানী, আহকামুল জানায়েয ১/৭৬)
.
জীবিতদের দান মৃতদের জন্য কল্যাণকর হওয়া আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের কাছে একটি স্বীকৃত বিষয়। মৌলিক দিক থেকে তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই;মতভেদ শুধু ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু মু‘তাযিলা সম্প্রদায় তা অস্বীকার করেছে। এদের মতে জীবিতদের দান করা কোন আমলই মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর নয়,দো‘আ-ইস্তিগফার ও সাদাক্বাও নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ইজমা বিরোধী,যা বাতিল।[ইমাম নববী, শারহু মুসলিম ১/৯০]
(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি