ইমাম যদি ভুলে একটা রুকু বা একটা সিজদাহ্ কিংবা একটা রাকআত অথবা একটা বসা বৃদ্ধি করেন তাহলে মুত্তাদীদের করণীয় কি

প্রশ্ন: জামাআতে সালাত আদায়ের সময় ইমাম যদি ভুলে একটা রুকু বা একটা সিজদাহ্ কিংবা একটা রাকআত অথবা একটা বসা বৃদ্ধি করেন তাহলে পিছনের মুত্তাদীদের করণীয় কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: সালাত ভঙ্গের কারণগুলো সুনির্দিষ্ট।কোন কোন কারণের ব্যাপারে ফিকাহ-বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতভেদের কারণে এর সংখ্যা কমবেশি হয়। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মতিক্রমে জামাআতে কিংবা একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সালাতের কোন একটি রুকন যেমন: একটা রুকু, সিজদাহ্, রাকআত কিংবা বসা ইত্যাদি বৃদ্ধি করে তাহলে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ তিনি সালাতে কিছু বৃদ্ধি করার অর্থ হলো আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতির ভিন্ন পদ্ধতিতে সালাত পড়া। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশনার ভিত্তিতে নয়—তা প্রত্যাখ্যাত।”(সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮) পক্ষান্তরে কেউ যদি ভুলবশতঃ কোন কিছু বৃদ্ধি করে তাহলে সালাত বাতিল হবে না। কিন্তু সালামের পর সাহু সিজদা দিতে হবে। এর পক্ষে দলীল হলো আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস; যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকেলের দুই সালাতের কোন এক সালাতে, সেটা যোহর কিংবা আসর, দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। তারা (সাহাবীরা) যখন বিষয়টি তাঁকে জানাল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি সালাত পড়ে সালাম ফেরালেন। সালামের পর তিনি দুটি সিজদাহ দিলেন।”[হাদীসটি বুখারী হা/৪৮২; ও মুসলিম হা/৫৭৩)আরো একটি দলীল হল ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস, তিনি বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে যোহরের সালাত পাঁচ রাকাত পড়ালেন। সালাত শেষে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল: ‘সালাত কি বৃদ্ধি করা হয়েছে?’ তিনি বললেন: “এ প্রশ্ন কেন?” তারা বলল: আপনি পাঁচ রাকাত সালাত পড়েছেন। তিনি তখন তার দুই পা ঘুরিয়ে কিবলামুখী হলেন এবং দুটি সিজদাহ দিলেন।”(সহীহ বুখারী হা/৪০৪; ও সহীহ মুসলিম হা/৫৭২)
.
দ্বিতীয়ত: জামআতে সালাত আদায়ের সময় যদি ইমাম ভুলে কিছু বৃদ্ধি করার পরেও ইমামের দৃষ্টিতে মনে হয় অতিরিক্ত হয়নি বরং ঠিক করেছেন বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন এবং মুক্তাদি মুসল্লীদের লুকমার মাধ্যমে সতর্ক করার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সালাত সম্পন্ন করেন অর্থাৎ একটা রুকু, একটা সিজদাহ, একটা বসা কিংবা একটা দাঁড়ানো অর্থাৎ চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতে পাঁচ রাকাআত সালাত আদায় করে থাকেন তবে তাঁর সালাত শুদ্ধ হয়েছে এবং তাঁর উপর কিছু করণীয় নেই। তবে সালাম ফিরানো শেষে যদি তাঁর প্রকৃত অবস্থা (তিনি যে ভুল করে একটা কিছু বৃদ্ধি করেছেন) খেয়াল হয়, তবে তিনি ভুল করার জন্য দুটি সাহু সেজদা দিয়ে সালাম ফিরাবেন। অপরদিকে যদি মুক্তাদি নিশ্চিতভাবে জেনে থাকেন যে ইমাম অতিরিক্ত একটা রুকু, সিজদাহ্ কিংবা অতিরিক্ত একটা রাকাআতের জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন তবে ইমামকে সতর্ক করা মুক্তাদির উপর ওয়াজিব। যদি ইমাম তা না শুনে তবে ইমামের অনুসরণ করা তার জন্য জায়েয নয়। বরং এক্ষেত্রে তিনি ইমাম থেকে আলাদা হয়ে অতিরিক্ত কিছু না করে স্থির থাকবেন এবং যথাযথ নিয়মে সঠিক এর ক্ষেত্রে ইমামের অনুসরণ করে সালাত সম্পন্ন করবেন। কিন্তু এমনটি না করে যদি মুক্তাদি নিশ্চিতভাবে জেনে বুঝে ইমামের অনুসরণ করে অতিরিক্ত কিছু (একটা রুকু, সিজদাহ্, পঞ্চম রাকাআত ইত্যাদি) আদায় করেন তবে তার সালাত বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি অজ্ঞতাবশত অথবা ভুল করে ইমামকে অনুসরণ করে থাকেন তবে তার (মুক্তাদির) সালাত শুদ্ধ হবে। তাঁর উপরও কিছু করণীয় নেই।
.
ইমাম আল-বুহুতি (রাহিমাহুল্লাহ) ‘শারহুর মুনতাহাল ইরাদাত গ্রন্থে বলেন;

ومن سها فنبهه ثقتان لزمه الرجوع ما لم يتيقن صوابَ نفسه
فلا يجوز رجوعه . . ”

ثم ذكر أنه إن قام إلى خامسة لم يجز للمأموم متابعته لأنه ” يعتقد خطأه , وأن ما قام إليه ليس من صلاته . فإن تبعه جاهلا , أو ناسيا , أو فارقه : صحت له (أي الصلاة) , ويلزم من علم الحال مفارقته ، ويسلم المفارق لإمامه بعد قيامه إلى الزائدة , وتنبيهه وإبائه الرجوع , إذا أتم التشهد الأخير ”

“যে ইমাম সালাতে ভুল করেছেন তাঁকে দুইজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি সতর্ক করবেন। তখন সে ভুল থেকে ফিরে আসা ইমামের উপর আবশ্যকীয়; যদি না তিনি তাঁর কাজ সঠিক হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। যদি ইমাম নিজের কাজ সঠিক হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাহলে (মুসল্লির কথা শুনে) ফিরে আসা জায়েয নয়।”

এরপর বলা হয়েছে-“তিনি যদি পঞ্চম রাকাআতের জন্য দাঁড়িয়ে যান সেক্ষেত্রে মুক্তাদির জন্য তাঁকে অনুসরণ করা জায়েয নয়। কারণ মুক্তাদি সুনিশ্চিত যে, ইমাম ভুল করছেন এবং যে রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছেন সেটা তার সালাতের অংশ নয়। এক্ষেত্রে মুক্তাদি যদি অজ্ঞতাবশত অথবা ভুলবশত ইমামের অনুসরণ করে যান অথবা যদি ইমাম থেকে আলাদা হয়ে যান তবে তার সালাত শুদ্ধ হবে। যে ব্যক্তি প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিতভাবে জানে, ইমামের অনুসরণ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া তার জন্য আবশ্যক। যে ব্যক্তি ইমাম থেকে আলাদা হয়ে গেছেন ইমাম অতিরিক্ত রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরতিনি আলাদাভাবে সালাম ফিরিয়ে নিবেন এবং শেষ তাশাহ্‌হুদ সম্পন্ন করার পর ভুল থেকে ফিরে আসার জন্য ইমামকে সতর্ক করবেন।”(শারহুর মুনতাহাল ইরাদাত; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২৩)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “যদি ইমাম ভুল করে পাঁচ রাকাআত সালাত আদায় করে ফেলে, তবে তাঁর সালাতের হুকুম কী এবং তাঁর পেছনে যারা সালাত আদায় করেছে তাদের সালাতের হু্কুম কী? এবং যে ব্যক্তি দেরীতে এসে ইমামের সাথে যোগ দিয়েছে সে কি এই অতিরিক্ত রাকাত গণনা করবে?”

তিনি উত্তরে বলেন :

إذا صلى الإمام خمسا سهوا فإن صلاته صحيحة ، وصلاة من اتبعه في ذلك ساهيا أو جاهلا صحيحة أيضا .

وأما من علم بالزيادة فإنه إذا قام الإمام إلى الزائدة وجب عليه أن يجلس ويسلم ، لأنه في هذه الحالة يعتقد أن صلاة إمامه باطلة إلا إذا كان يخشى أن إمامه قام إلى الزائدة ، لأنه أخل بقراءة الفاتحة ( مثلا ) في إحدى الركعات فحينئذ ينتظر ولا يسلم ( أي ينتظر حتى يسلم مع الإمام ) .

وأما بالنسبة للمسبوق الذي دخل مع الإمام في الثانية فما بعدها فإن هذه الركعة الزائدة تحسب له ، فإذا دخل مع الإمام في الثانية مثلا سلم مع الإمام الذي زاد ركعة ، وإن دخل في الثالثة أتى بركعة بعد سلام الإمام من الزائدة ، وذلك لأننا لو قلنا بأن المسبوق لا يعتد بالزائدة للزم من ذلك أن يزيد ركعة عمدا ، وهذا موجب لبطلان الصلاة ، أما الإمام فهو معذور بالزيادة ، لأنه كان ناسيا فلا تبطل صلاته

“যদি ইমাম ভুল করে পাঁচ রাকাত সালাত আদায় করে তবে তাঁর সালাত শুদ্ধ এবং যে মুক্তাদিরা ভুলবশত অথবা অজ্ঞতাবশত তাঁকে অনুসরণ করেছে তাদের সালাতও শুদ্ধ। কিন্তু যে মুক্তাদি নিশ্চিত থাকেন যে, এটি অতিরিক্ত রাকাত, তার জন্য ইমাম পঞ্চম রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে বসে পড়া ও সালাম ফিরিয়ে ফেলা ওয়াজিব। কারণ এক্ষেত্রে তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে ইমামের সালাত সঠিক নয়। যদি তিনি এ আশংকা করেন যে, ইমাম কোন একরাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ায় গরমিল করেছেন বিধায় অতিরিক্ত পঞ্চম রাকাত পড়ছেন সেক্ষেত্রে তিনি সালাম না ফিরিয়ে ইমামের জন্য অপেক্ষা করবেন। অর্থাৎ ইমামের সাথে সালাম ফিরানোর জন্য অপেক্ষা করবেন।

আর যে ব্যক্তি দেরিতে এসে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকাতে বা পরবর্তী কোন রাকাতে যোগ দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সালাত আদায় করেছে, এ অতিরিক্ত রাকাতটি তার ক্ষেত্রে গণনা করা হবে। যদি সে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকাতে যোগ দেয়, তবে সে ইমামের সাথে অতিরিক্ত রাকাতসহ সালাম ফিরাবে। আর যদি সে তৃতীয় রাকাতে এসে যোগ দেয়, তবে ইমামের অতিরিক্ত রাকাতের সালাম ফিরানো শেষে আরেক রাকাত যোগ করবে। কারণ আমরা যদি বলি, যে মুক্তাদি দেরিতে যোগ দিয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রাকাতটি গণ্য হবে না, তবে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত এক রাকাত যোগ করতে হবে- যা সালাত বাতিল হওয়ার কারণ। পক্ষান্তরে এই ইমাম অতিরিক্ত রাকাত আদায় করার ক্ষেত্রে ওজরগ্রস্ত। কারণ তিনি ভুল করেছেন। তাই তাঁর সালাত বাতিল হবে না।”(উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৯) আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৮৭৮৫৩) (আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)।
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)।

Share: