আশুরার রোজা কোন দুইদিন রাখা উচিত

প্রশ্ন: আশুরার রোজা কোন দুইদিন রাখা উচিত। মহররম মাসের ৯ এবং ১০ তারিখ নাকি ১০ এবং ১১ তারিখ। কোনটি অধিক উত্তম?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: একটি বিষয় পরিস্কার ভাবে জানা দরকার আর তা হচ্ছে, আশুরা নামটি শুনলেই আমাদের মনে হয় ভ্রান্ত শী‘আদের তথাকথিত তাজিয়া ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সপরিবারে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণের মর্মান্তিক ঘটনা। অথচ কারবালার ঘটনার সাথে আশুরার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। আশুরা হল আরবী মাস সমূহের প্রথম মাস তথা মুহাররম মাসের দশম তারিখ। এই তারিখে আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহে মিসরের অত্যাচারী জালিম সম্রাট ফেরাঊন সাগরে ডুবে মরেছিল এবং মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথী বনু ইস্রাঈলগণ ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে মূসা (আঃ) এদিন সিয়াম রাখেন’।(সহীহ মুসলিম হা/১১৩০)। আর সে কারনে প্রতি বছরের এই দিনটি নাজাতে মূসার শুকরিয়ার নিয়তে সিয়াম রাখা মুস্তাহাব। যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম নিয়মিতভাবে পালন করতেন। এই সিয়ামই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জাহেলী যুগেও এ সিয়াম চালু ছিল। রাসূল (ﷺ) নবুঅত পূর্বকালে ও পরে আশুরার সিয়াম রাখতেন। ২য় হিজরীতে রমাযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশূরার সিয়াম মুসলিমদের জন্য ‘ফরয’ ছিল। এরপর যখন রমজানের সিয়াম ফরজ হয় তখন এটি নফল সিয়ামে পরিণত হয়।[সহীহ মুসলিম, হা/১১২৮; মিশকাত, হা/২০৬৯ ‘সিয়াম’ অধ্যায়, ‘নফল সিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬]
.
আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মোচন করে। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “আমি আল্লাহর নিকট প্রতিদান প্রত্যাশা করছি আরাফার রোজা বিগত বছর ও আগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে। আরও প্রত্যাশা করছি আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে।”(সহিহ মুসলিম হা/ (১১৬২) এটি আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ একদিনের রোজার মাধ্যমে বিগত বছরের সব গুনাহ মার্জনা হয়ে যাবে।নিশ্চয় আল্লাহ মহান অনুগ্রহকারী।
আশুরার রোজার মহান মর্যাদার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি এ রোজার ব্যাপারে খুব আগ্রহী থাকতেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “ফজিলতপূর্ণ দিন হিসেবে আশুরার রোজা ও এ মাসের রোজা অর্থাৎ রমজানের রোজার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যত বেশি আগ্রহী দেখেছি অন্য রোজার ব্যাপারে তদ্রূপ দেখিনি।”(সহিহ বুখারি হা/১৮৬৭) হাদিসে يتحرى শব্দের অর্থ- সওয়াব প্রাপ্তি ও আগ্রহের কারণে তিনি এ রোজার প্রতীক্ষায় থাকতেন।আর আশুরার রোজা দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মার্জনা হবে। কবিরা গুনাহ বিশেষ তওবা ছাড়া মোচন হয় না।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

يُكَفِّرُ (صيام يوم عرفة) كُلَّ الذُّنُوبِ الصَّغَائِرِ , وَتَقْدِيرُهُ يَغْفِرُ ذُنُوبَهُ كُلَّهَا إلا الْكَبَائِرَ.ثم قال رحمه الله: صَوْمُ يَوْمِ عَرَفَةَ كَفَّارَةُ سَنَتَيْنِ , وَيَوْمُ عَاشُورَاءَ كَفَّارَةُ سَنَةٍ , وَإِذَا وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ الْمَلائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ… كُلُّ وَاحِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَذْكُورَاتِ صَالِحٌ لِلتَّكْفِيرِ فَإِنْ وَجَدَ مَا يُكَفِّرُهُ مِنْ الصَّغَائِرِ كَفَّرَهُ , وَإِنْ لَمْ يُصَادِفْ صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً كُتِبَتْ بِهِ حَسَنَاتٌ وَرُفِعَتْ لَهُ بِهِ دَرَجَاتٌ ,.. وَإِنْ صَادَفَ كَبِيرَةً أَوْ كَبَائِرَ وَلَمْ يُصَادِفْ صَغَائِرَ , رَجَوْنَا أَنْ تُخَفِّفَ مِنْ الْكَبَائِرِ.

“আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহ মোচন করে। হাদিসের বাণীর মর্ম রূপ হচ্ছে কবিরা গুনাহ ছাড়া সকল গুনাহমোচন করে দেয়।এরপর তিনি আরও বলেন: আরাফার রোজা দুই বছরের গুনাহ মোচন করে। আর আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ মোচন করে। মুক্তাদির আমীন বলা যদি ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যায় তাহলে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়… উল্লেখিত আমলগুলোর মাধ্যমে পাপ মোচন হয়। যদি বান্দার সগিরা গুনাহ থাকে তাহলে সগিরা গুনাহ মোচন করে। যদি সগিরা বা কবিরা কোন গুনাহ না থাকে তাহলে তার আমলনামায় নেকি লেখা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। যদি কবিরা গুনাহ থাকে, সগিরা গুনাহ না থাকে তাহলে কবিরা গুনাহকে কিছুটা হালকা করার আশা করতে পারি।[আল-মাজমু শারহুল মুহাযযাব, খণ্ড-৬] শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: وَتَكْفِيرُ الطَّهَارَةِ، وَالصَّلاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَعَرَفَةَ، وَعَاشُورَاءَ لِلصَّغَائِرِ فَقَطْ “পবিত্রতা অর্জন, নামায আদায়, রমজানের রোজা রাখা, আরাফার দিন রোজা রাখা, আশুরার দিন রোজা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সগিরা গুনাহ মোচন হয়।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খণ্ড-৫]
.
▪️দ্বিতীয়ত: আশুরার রোজা কোন দুইদিন রাখা উচিত; এই বিষয়ে আশুরার সিয়াম সম্পর্কে হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আশুরার সিয়াম তিনভাবে রাখার বর্ননা পাওয়া যায়।

✿ সর্বোত্তম এবং সুন্নাহ পদ্ধতি হল আশুরার আগের দিন (৯ তারিখ) ও আশুরার দিন (১০ তারিখে) সিয়াম রাখা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ তারিখে রোযা রেখেছেন এবং ৯ তারিখে রোযা রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
.
✿ দ্বিতীয় পদ্ধতি হল অনিচ্ছায় যদি কারো ৯ তারিখের সিয়াম ছুটে যায় তাহলে একদল আলেমদের মতে ১০ এবং ১১ তারিখে রাখা যেতে পারে। তারা বলেন ১১ তারিখে রোজা রাখা সংক্রান্ত হাদীসটি মারফূ সূত্রে সহীহ না হলেও মওকুফ সূত্রে সহীহ হিসেবে মুহররম মাসের ১১ তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব।
.
✿ তৃতীয় পদ্ধতি হল ৯ তারিখ রাখতে না পারলে
অন্তত আশুরার দিন (১০ তারিখে) সিয়াম রাখা।
শুধু আশুরার দিন রোজা রাখাও জায়েয। যদিও একদল আলেম মাকরুহ বলেছেন তবে শুধু আশুরার দিন (১০ তারিখ সিয়াম পালন করা যাবে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে উত্তম হলো দুইটি সিয়াম রাখা। অর্থাৎ আশুরার দিন এবং এর আগের দিন।
.
প্রথম পদ্ধতি অনুযায়ী অর্থাৎ মহররম মাসের ৯ এবং ১০ তারিখে সিয়াম পালন করা সর্বোত্তম। এই মর্মে দলিল হচ্ছে যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বর্ণনা করেন যে,তিনি বলেন: حِينَ صَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.”যখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোযা রাখলেন এবং রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবীরা বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! এই দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা মর্যাদা দিয়ে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ইন্‌শাআল্লাহ্‌ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও রোযা রাখব। তিনি বলেন: আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেলেন।”(সহিহ মুসলিম হা/১৯১৬)
.
উক্ত হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২০৪ হি.] ও তাঁর অনুসারীরা, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.] ইমাম ইসহাক প্রমুখ (রাহিমাহুল্লাহ) আলেমগণ বলেন:يستحب صوم التاسع والعاشر جميعا؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم صام العاشر، ونوى صيام التاسع. ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ উভয় দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ তারিখে রোযা রেখেছেন এবং ৯ তারিখে রোযা রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন”। সুতরাং এ আলোচনার প্রেক্ষিতে আশুরার রোযা রাখার একাধিক স্তর রয়েছে। সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে শুধু ১০ তারিখে রোযা রাখা। এর উপরের স্তর হচ্ছে ৯ তারিখের সাথে অন্য একদিনও রোযা রাখা। আর মুহররম মাসে যতবেশি রোযা রাখা যায় তত উত্তম।
.
এখন যদি কেউ বলেন যে ১০ তারিখের সাথে ৯ তারিখ রোযা রাখার গূঢ় রহস্য কী?
.
উক্ত প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

ذَكَرَ الْعُلَمَاءُ مِنْ أَصْحَابِنَا وَغَيْرِهِمْ فِي حِكْمَةِ اسْتِحْبَابِ صَوْمِ تَاسُوعَاءَ أَوْجُهًا:

• ( أَحَدُهَا) أَنَّ الْمُرَادَ مِنْهُ مُخَالَفَةُ الْيَهُودِ فِي اقْتِصَارِهِمْ عَلَى الْعَاشِرِ , وَهُوَ مَرْوِيٌّ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ..

• ( الثَّانِي) أَنَّ الْمُرَادَ بِهِ وَصْلُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ بِصَوْمٍ، كَمَا نَهَى أَنْ يُصَامَ يَوْمُ الْجُمُعَةِ وَحْدَهُ..

( الثَّالِثَ) الاحْتِيَاطُ فِي صَوْمِ الْعَاشِرِ خَشْيَةَ نَقْصِ الْهِلالِ، وَوُقُوعِ غَلَطٍ فَيَكُونُ التَّاسِعُ فِي الْعَدَدِ هُوَ الْعَاشِرُ فِي نَفْسِ الأَمْرِ.

“আমাদের মাযহাবের আলেমগণ ও অন্যান্য আলেমগণ ৯ তারিখে রোযা রাখার গূঢ় রহস্য সম্পর্কিত কয়েকটি দিক উল্লেখ করেছেন:

১. এর পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদীদের সাথে পার্থক্য তৈরী করা। যেহেতু তারা শুধু ১০ তারিখে রোযা রাখে। এটি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত।

২. আশুরার দিনের সাথে আরও একটি রোযাকে মিলানো। যেমনটি এককভাবে শুধু জুমার দিন রোযা রাখা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।

৩. দশ তারিখের রোযাটির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা এই আশংকায় যে, চাঁদের হিসাবে কমতি হতে পারে, ভুল হতে পারে। তখন হিসাবে যেদিনই ৯ তারিখ বাস্তবে সেই দিন ১০ তারিখ হবে।(ইসলামি সওয়াল-জবাব)
.
সুতরাং উল্লেখিত এ দিকগুলোর মধ্যে আহলে কিতাবদের সাথে পার্থক্য তৈরা করা এটি সবচেয়ে মজবুত। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:نَهَى صلى الله عليه وسلم عَنْ التَّشَبُّهِ بِأَهْلِ الْكِتَابِ فِي أَحَادِيثَ كَثِيرَةٍ مِثْلُ قَوْلِهِ.. فِي عَاشُورَاءَ: لَئِنْ عِشْتُ إلَى قَابِلٍ لأَصُومَنَّ التَّاسِعَ.”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক হাদিসে আহলে কিতাবদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে বারণ করেছেন। যেমন, আশুরার ব্যাপারে তাঁর বাণী: “যদি আমি আগামী বছর বাঁচি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখে রোযা রাখব।”(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা; খণ্ড-০৫)

শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ,হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] “যদি আমি আগামী বছর বাঁচি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখে রোযা রাখব।” এই হাদিসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:”ما همّ به من صوم التاسع يُحتمل معناه أن لا يقتصر عليه بل يُضيفه إلى اليوم العاشر إما احتياطاً له وإما مخالفةً لليهود والنصارى وهو الأرجح وبه يُشعر بعض روايات مسلم.”তিনি যে, ৯ তারিখে রোযা রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এর ব্যাখ্যা হচ্ছে শুধু ৯ তারিখে রোযা রাখা নয়; বরং ১০ তারিখের সাথে ৯ তারিখেও রোযা রাখা; সতর্কতামূলক কিংবা ইহুদি-নাসারাদের বিরুদ্ধাচারণমূলক। শেষোক্ত কারণটি অগ্রগণ্য। সহিহ মুসলিমের কিছু রেওয়ায়েত থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়”(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ২৪৫)
.
▪️দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুযায়ী অর্থাৎ অনিচ্ছায় যদি কারো ৯ তারিখের সিয়াম ছুটে যায়,অথবা স্বাভাবিক ভাবেও ১০ এবং ১১ তারিখে রাখা যেতে পারে। এই মর্মে বর্নিত হাদীসটি মারফূ সূত্রে সহীহ না হলেও মওকুফ সূত্রে সহীহ হিসেবে মুহররম মাসের ১১ তারিখে রোযা রাখাকে একদল আলেমগণ মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ দিনে রোযা রাখার নির্দেশ এসেছে। হাদীসটি হচ্ছে,প্রখ্যাত সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:: صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا.”তোমরা আশুরার দিন (১০ তারিখে) রোযা রাখ। এক্ষেত্রে তোমরা ইহুদীদের সাথে পার্থক্য কর এবং আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোযা রাখ।”(মুসনাদে আহমাদ হা/২১৫৫)

তাহক্বীক: মুহাদ্দিস, আলেমগণ মুসনাদে আহমেদের এ হাদিসের শুদ্ধতা নিয়ে মতভেদ করেছেন। শাইখ আহমাদ শাকের হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। আর মুসনাদ গ্রন্থের মুহাক্কিকগণ হাদিসটিকে ‘যয়ীফ’ (দুর্বল) বলেছেন। এ হাদিসটি ইবনে খুযাইমাও এই ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন: “إسناده ضعيف، لسوء حفظ ابن أبي ليلى، وخال عطاء وغيره فرواه عن ابن عباس موقوفاً، وسنده صحيح عند الطحاوي والبيهقي “ইবনে আবি লাইলা নামক বর্ণনাকারীর মুখস্তশক্তির দুর্বলতার কারণে হাদিসটির সনদ ‘যয়ীফ’। বর্ণনাকারী ‘আতা’ তার সাথে মতভেদ করেছেন এবং তিনি হাদিসটিকে ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর উক্তি (মাওকুফ) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।তাহাবী ও বাইহাকী কর্তৃক সংকলিত সে সনদটি সহিহ।(সহীহ ইবনে খুযাইমাহ হা/২০৯৫ টীকা দ্রঃ)
.
সুতরাং যদি এ হাদিসটির সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের হয় তাহলে তো ভাল। আর যদি হাদিসটি ‘যয়ীফ’ হয় তাহলে এমন ক্ষেত্রে আলেমগণ সহনশীলতা অবলম্বন করেন। কেননা হাদিসটির দুর্বলতা যৎসামান্য। তারা বলেন, যেহেতু হাদিসটি মিথ্যা বা বানোয়াট নয়। এবং যেহেতু হাদিসটি ফাযায়েলে আমল এর ক্ষেত্রে। বিশেষতঃ যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুহররম মাসে রোযা রাখার ব্যাপারে উৎসাহমূলক বর্ণনা এসেছে। এমনকি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:”‏ أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ ‏”‏ ‏.“রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হচ্ছে- আল্লাহর মাস ‘মুহররম’ এর রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামায হচ্ছে রাত্রিকালীন নামায।”[সহিহ মুসলিম হা/১১৬৩) উক্ত হাদিসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে মাসকে আল্লাহর সাথে সম্বন্ধিত করা হয়েছে মাসটির মর্যাদা তুলে ধরতে। আল-ক্বারী বলেন: হাদিস থেকে বাহ্যতঃ মনে হচ্ছে- গোটা মুহররম মাস (রোজা রাখা) উদ্দেশ্য। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি রমজান ছাড়া আর কোন মাসের গোটা সময় রোজা রাখেননি। তাই এ হাদিসের এ অর্থ গ্রহণ করতে হবে যে, মুহররম মাসে অধিক রোজা রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে; গোটা মাস রোজা রাখা নয়।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২১৩১১)
.
কোন কোন আলেম ১১ তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব হওয়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে ১০ তারিখের রোযাটির ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। কারণ হতে পারে লোকেরা মুহররম মাসের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ভুল করে থাকবে। যার কারণে সুনির্দিষ্টভাবে কোন দিনটি ১০ তারিখ সেটা হয়তো জানা যাবে না। তাই মুসলিম ব্যক্তি যদি ৯ তারিখ ও ১১ তারিখ রোযা রাখে তাহলে নিশ্চিতভাবে তার আশুরা (১০ তারিখ) এর রোযা রাখা হল। ইবনে আবু শাইবা তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে (২/৩‌১৩) তাউস (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি আশুরার আগে এক দিন ও পরে একদিন রোযা রাখতেন; ছুটে যাওয়ার ভয় থেকে।ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্ভল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “من أراد أن يصوم عاشوراء صام التاسع والعاشر إلا أن تشكل الشهور فيصوم ثلاثة أيام، ابن سيرين يقول ذلك” “যে ব্যক্তি আশুরার রোযা রাখতে চায় সে যেন ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ রোযা রাখে। তবে মাসগুলো নিয়ে কোন অনিশ্চয়তা থাকলে তাহলে তিনদিন রোযা রাখবে। ইবনে সিরিন এই অভিমত ব্যক্ত করতেন।”(ইবনে কুদামাহ, আল-মুগনি (৪/৪৪১)
.
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে ফুটে উঠল যে, ইমাম আহমেদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য অনুযায়ী তিন দিন রোযা রাখাকে বিদাত বলা ঠিক হবে না। যদিও জমহুর আলেমগন বিদআত বলেছেন,আর যে ব্যক্তি কোন কারনে ৯ তারিখে রোযা রাখতে পারেনি সে ব্যক্তি শুধু ১০ তারিখে রোযা রাখতে কোন অসুবিধা নেই, এটা মাকরুহ হবে না। আল-মিরদাওয়ি তার ‘ইনসাফ’ গ্রন্থে বলেন:”لا يكره إفراد العاشر بالصيام على الصحيح من المذهب، ووافق الشيخ تقي الدين [ابن تيمية] أنه لا يكره” “মাযহাবের সঠিক মতানুযায়ী, এককভাবে ১০ তারিখ রোযা রাখা মাকরুহ নয়। শাইখ তাকী উদ্দিন (ইবনে তাইমিয়া) ও একমত পোষণ করেছেন যে, মাকরুহ হবে না।(সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত আল ইনসাফ’ খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
পরিশেষে, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিব সেটা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম হারাম মাস হিসেবে তাকে সম্মান করা, আশুরায়ে মুহাররমের ২ দিন সিয়াম পালন করা, সিয়ামের নিয়ত অবশ্যই নাজাতে মূসা উপলক্ষে হওয়া, সিয়াম ৯-১০ রাখায় উত্তম তবে ৯ তারিখ অনিচ্ছাকৃত মিস হয়ে গেলে কারো মতে ১০-১১ তারিখও রাখা যায়, আমরা বলবো ৯ এবং ১০ তারিখেই সিয়াম রাখুন কেননা এটাই সুন্নাহ। এখানে একটি বিষয় ভালো ভাবে মনে রাখবেন: আশুরার সিয়াম কিন্ত একদিন। সেটি হল মুহাররামের ১০ তারিখ। ১০ তারিখের সিয়ামটিই আশুরার নিয়তে রাখবেন। এর আগের দিন বা পরের দিনের সিয়াম সাধারণ নফলের নিয়তে রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং সকল সৎ আমলগুলো কবুল করুন। আমীন!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: