প্রশ্ন: আমরা জানি আল্লাহ আমাদের রিযিক লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কিন্তু রিযিকের মধ্যে কি কি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রিযিকের মধ্যে প্রশস্ততা লাভের উপায়গুলো কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আল্লাহ্ তাআলার নামসমূহের মধ্যে রয়েছে الرَّزَّاق (আর-রাজ্জাক— রিযিকদাতা)। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর আমি জ্বিন-ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমারই ইবাদত করার জন্য। আমি তাদের কাছে কোন রিযিক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে। নিশ্চয় আল্লাহ; তিনি প্রকৃষ্টভাবে রিযিকদাতা, প্রবল শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮) অপর আয়াতে আল্লাহ আরো বলেছেন: “আর যমীনে বিচরণকারী সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি সেসবের স্থায়ী অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত; সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে আছে।(সূরা হুদ: ৬) আরবী الرَّزَّاق শব্দটি ইসমুল ফায়েল رَازِق থেকে اسم المبالغة (বাহুল্য প্রকাশক শব্দ) হিসেবে গঠিত। যার অর্থ হচ্ছে- অধিক দাতা। আর রিযিকের আভিধানিক অর্থ এমন বস্তু যা কোন প্রাণী আহার্যরূপে গ্রহণ করে, যার দ্বারা সে দৈহিক শক্তি সঞ্চয়, প্রবৃদ্ধি সাধন এবং জীবন রক্ষা করে থাকে। রিযিকের জন্য মালিকানা স্বত্ব শর্ত নয়। সকল জীব জন্তু রিযিক ভোগ করে থাকে কিন্তু তারা তার মালিক হয় না। কারণ, মালিক হওয়ার যোগ্যতাই ওদের নেই। অনুরূপভাবে ছোট শিশুরাও মালিক নয়, কিন্তু ওদের রিযিক অব্যাহতভাবে তাদের কাছে পৌছতে থাকে।(তাফসীরে কুরতুবী)
.
মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু তাকদীর (নির্ধারণ) করে রেখেছেন, যা কিছু তিনি তাঁর ভাণ্ডার থেকে তাদের জন্য নাযিল করেছেন; যেমন- সম্পদ, সন্তান, স্ত্রী, জ্ঞান, কর্ম, চরিত্র ও স্বাস্থ্য… সবই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বান্দার জন্য রিযিক। চাই সেগুলো তাদের নিজেদের কামাই হোক; কিংবা তারা ওয়ারিশসূত্রে পেয়ে থাকুক কিংবা উপহারের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছুক। চাই সেগুলো হালাল হোক কিংবা হারাম হোক। সবই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বান্দার জন্য রিযিক। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর আসমানে রয়েছে তোমাদের রিযিক ও প্রতিশ্রুত সব কিছু।”[সূরা যারিয়াত, আয়াত: ২২] তিনি আরও বলেন: “আর তোমাদের কাছে যে সব নেয়ামত রয়েছে তা তো আল্লাহ্রই কাছ থেকে;”[সূরা নাহল, আয়াত: ৫৩] ইমাম বাইহাক্বী বলেন: قَالَ أَبُو سُلَيْمَانَ فِيمَا أُخْبِرْتُ عَنْهُ : الرَّزَّاقُ هُوَ الْمُتَكَفِّلُ بِالرِّزْقِ ، وَالْقَائِمُ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا يُقِيمُهَا مِنْ قُوتِهَا .قَالَ : وَكُلُّ مَا وَصَلَ مِنْهُ إِلَيْهِ ، مِنْ مُبَاحٍ وَغَيْرِ مُبَاحٍ : فَهُوَ رِزْقُ اللهِ ، عَلَى مَعْنَى أَنَّهُ قَدْ جَعَلَهُ لَهُ قُوتًا وَمَعَاشًا “আবু সুলাইমান বলেন; (যা তাঁর পক্ষ থেকে আমার কাছে বর্ণনা করা হয়েছে): الرَّزَّاق (আল-রাজ্জাক) হলেন: রিযিকের দায়িত্বগ্রহণকারী এবং প্রত্যেক প্রাণীর খাদ্যের দায়িত্বগ্রহণকারী; যে খাদ্য তার মেরুদণ্ডকে সোজা রাখে। তিনি আরও বলেন: প্রত্যেক যা কিছু তাঁর পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছে; সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ হোক সেটি আল্লাহ্র দেয়া রিযিক। অর্থাৎ আল্লাহ্ সেটাকে তার জন্য খাদ্য ও জীবিকা বানিয়েছেন।”(বায়হাকী আল-আসমা ওয়াল হুসান; খন্ড: ১পৃষ্ঠা: ১৭২)
.
কোন বান্দার কাছে অন্যের কাছ থেকে যা কিছু পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটাকে রিযিক হিসেবে অভিহিত করেছেন।যেমন: আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: (مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مِنْ هَذَا الْمَالِ شَيْئًا مِنْ غَيْرِ أَنْ يَسْأَلَهُ فَلْيَقْبَلْهُ ؛ فَإِنَّمَا هُوَ رِزْقٌ سَاقَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَيْهِ ) “যে ব্যক্তিকে আল্লাহ্ এই সম্পদ থেকে কোন কিছু (কারো কাছে) চাওয়া ব্যতীত প্রদান করেছেন সে সেটা গ্রহণ করুক। কারণ সেটি আল্লাহ্র রিযিক; আল্লাহ্ আয্যা ওয়া জাল্লা সেটি তার দিকে টেনে এনেছেন।”(মুসনাদে আহমাদ হা/৭৯০৮‘সহিহুল জামে’ হা/৫৯২১) অপর বর্ননায় কা’কা’ বিন হাকিম থেকে বর্ণিত আছে যে, আব্দুল্লাহ্ বিন উমরের (রাঃ) কাছে আব্দুল আযিয বিন মারওয়ান এই মর্মে চিঠি লিখেন যে, আমার কাছে আপনার প্রয়োজন পেশ করুন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রাঃ) জবাবে লিখেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: “আপনি যাদের খরপোষ চালান তাদের দিয়ে শুরু করুন। উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে উত্তম।” আমি ধারণা করি উপরের হাত হচ্ছে দানকারী হাত; আর নীচের হাত হচ্ছে অনুদানপ্রার্থী হাত। আমি আপনার কাছে কোন কিছুর প্রার্থনাকারী নই এবং আল্লাহ্ আপনার পক্ষ থেকে কোন কিছু আমার কাছে টেনে আনলে সেটাকে প্রত্যাখানকারীও নই।”[মুসনাদে আহমাদ হা/৬৪০২।
মুসনাদের মুহাক্কিকগণ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, لَا تَسْتَبْطِئُوا الرِّزْقَ فَإِنَّهُ لَنْ يَمُوتَ الْعَبْدُ حَتَّى يَبْلُغَهُ آخِرُ رِزْقٍ هُوَ لَهُ فَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ أَخذ الْحَلَال وَترك الْحَرَام- “রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করো না। কেননা কোন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মারা যায় না যতক্ষণ না তার নির্ধারিত শেষ রিযক তার কাছে পৌঁছে যায়। অতঃপর তোমরা হালাল রিযক সুন্দরভাবে তালাশ কর। আর হারাম থেকে বিরত হও”।(মুসতাদরাক হা/২১৩৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৬০৭))।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:
لَفْظَ ” الرِّزْقِ ” يُرَادُ بِهِ مَا أَبَاحَهُ اللَّهُ تَعَالَى لِلْعَبْدِ وَمَلَّكَهُ إيَّاهُ .
وَيُرَادُ بِهِ مَا يَتَغَذَّى بِهِ الْعَبْدُ :
فَالْأَوَّلُ : كَقَوْلِهِ : ( وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ ) ، ( وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ) ، فَهَذَا الرِّزْقُ هُوَ الْحَلَالُ وَالْمَمْلُوكُ لَا يَدْخُلُ فِيهِ الْخَمْرُ وَالْحَرَامُ .
وَالثَّانِي : كَقَوْلِهِ : (وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا ) ؛ وَاَللَّهُ تَعَالَى يَرْزُقُ الْبَهَائِمَ ، وَلَا تُوصَفُ بِأَنَّهَا تَمْلِكُ ، وَلَا بِأَنَّهُ أَبَاحَ اللَّهُ ذَلِكَ لَهَا إبَاحَةً شَرْعِيَّةً ؛ فَإِنَّهُ لَا تَكْلِيفَ عَلَى الْبَهَائِمِ – وَكَذَلِكَ الْأَطْفَالُ وَالْمَجَانِينُ – لَكِنْ لَيْسَ بِمَمْلُوكِ لَهَا وَلَيْسَ بِمُحَرَّمِ عَلَيْهَا .
وَإِنَّمَا الْمُحَرَّمُ : بَعْضُ الَّذِي يَتَغَذَّى بِهِ الْعَبْدُ ، وَهُوَ مِنْ الرِّزْقِ الَّذِي عَلِمَ اللَّهُ أَنَّهُ يَتَغَذَّى بِهِ ، وَقَدَّرَ ذَلِكَ ؛ بِخِلَافِ مَا أَبَاحَهُ وَمَلَّكَهُ .
كَمَا فِي الصَّحِيحَيْنِ عَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ : ( يُجْمَعُ خَلْقُ أَحَدِكُمْ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا نُطْفَةً ، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يُبْعَثُ الْمَلَكُ ، فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ : فَيُقَالُ : اُكْتُبْ رِزْقَهُ ، وَأَجَلَهُ ، وَعَمَلَهُ ، وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ ، ثُمَّ يُنْفَخُ فِيهِ الرُّوحُ ، قَالَ : فَوَاَلَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إلَّا ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ فَيَدْخُلَهَا وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إلَّا ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيْهِ الْكِتَابُ فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيَدْخُلَهَا ) .وَالرِّزْقُ الْحَرَامُ مِمَّا قَدَّرَهُ اللَّهُ ، وَكَتَبَتْهُ الْمَلَائِكَةُ ، وَهُوَ مِمَّا دَخَلَ تَحْتَ مَشِيئَةِ اللَّهِ وَخَلْقِهِ ، وَهُوَ مَعَ ذَلِكَ قَدْ حَرَّمَهُ وَنَهَى عَنْهُ ؛ فَلِفَاعِلِهِ مِنْ غَضَبِهِ وَذَمِّهِ وَعُقُوبَتِهِ مَا هُوَ أَهْلُهُ – وَاَللَّهُ أَعْلَمُ .”
“রিযিক শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয় যা আল্লাহ্ বান্দার জন্য বৈধ করেছেন ও তাকে যেটার মালিক বানিয়েছেন। এছাড়া যা কিছুকে বান্দা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে রিযিক দ্বারা সেটাকেও বুঝানো হয়।
প্রথমটির উদাহরণ হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ (এবং আমরা তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর) এবং তাঁর বাণী: وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ (এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে)[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ৩] এই প্রকারের রিযিক হলো হালাল। যেহেতু মদ ও হারাম জিনিস কারো মালিকানায় প্রবেশ করে না।
আর দ্বিতীয়টির উদাহরণ হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا (আর যমীনে বিচরণকারী সবার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহ্রই।)[সূরা হুদ, আয়াত: ৬] আল্লাহ্ তাআলা পশুকেও রিযিক দেন। কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, ‘পশু সেই রিযিকের মালিক’ কিংবা ‘আল্লাহ্ পশুর জন্য আইনগতভাবে সেটাকে বৈধ করেছেন’। কেননা পশুদের উপর কোন শরয়ি দায়িত্ব আরোপ করা হয়নি; যেমনিভাবে শিশু ও পাগলদের উপর কোন দায়িত্ব আরোপ করা হয়নি। তাই সেই রিযিক পশুদের মালিকানাধীন নয় কিংবা তাদের জন্য হারামও নয়।
হারাম হলো বান্দা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এমন কিছু জিনিস। এগুলো ঐ রিযিকের অন্তর্ভুক্ত যেটার ব্যাপারে আল্লাহ্ পূর্ব থেকেই জানেন যে, বান্দা এটাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে এবং তিনিই এটা তাকদীর (নির্ধারণ) করে রেখেছেন। এই রিযিক যা তার জন্য হালাল করেছেন ও তাকে যেটার মালিক বানিয়েছেন সেটার বিপরীত।
সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে ইবনে মাসউদ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “তোমাদের সৃষ্টির উপাদানকে নিজ মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়— চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে, অতঃপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয় অনুরূপ সময়ে। এরপর তা গোশতপিন্ডে পরিণত হয় অনুরূপ সময়ে। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। ফেরেশতাকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। তাঁকে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়: তার আমল, তার রিযিক, তার আয়ু এবং সে কি পাপী হবে; নাকি নেককার হবে। অতঃপর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়। সেই সত্তার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ! তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতের অধিবাসীর আমল করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে। এরপর তাকদীরের লিখন তার উপর জয়ী হয়ে যায়। তখন সে জাহান্নামবাসীর মত আমল করতে থাকে; অবশেষে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। আর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি জাহান্নামবাসীর কর্ম করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র একহাত ব্যবধান থাকে। তখন ভাগ্যলিপি তার উপর জয়ী হয়ে যায়। ফলে সে জান্নাতীদের ন্যায় আমল করতে থাকে। অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করে।” হারাম রিযিকও আল্লাহ্ কর্তৃক তাকদীরকৃত, যা ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এবং যা আল্লাহ্র ইচ্ছা ও সৃষ্টিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। তদুপরি তিনি সেটাকে হারাম করেছেন এবং সেটা থেকে নিষেধ করেছেন। তাই হারাম রিযিক উপার্জনকারীর জন্য আল্লাহ্র গজব, নিন্দাবাদ ও শাস্তি; যতটুকু সে প্রাপ্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।।(মাজমুউল ফাতাওয়া; খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৫৪৫; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং ১৯৪৫০৩)
.
▪️রিযিকে প্রশস্ততা লাভের অনেক মাধ্যম কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। জ্ঞাতার্থে কয়েকটি উল্লেখ্য করা হলো-
(১).তাক্বওয়ার (আল্লাহভীতি) পথ অবলম্বন করা।আল্লাহ তা‘আলার উপর পূর্ণাঙ্গ ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং আল্লাহভীতির পোশাক পরিধান করা। ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জন্য নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের বারাকাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেবেন।যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে দান করবেন রিযিক” (সূরা আত-তালাক্ব, ৬৫/২-৩)।
(২).পাপের জন্য অধিকহারে তওবাহ এবং ইস্তিগফার করা : তওবাহ অর্থ পাপ থেকে প্রত্যাবর্তন করা এবং গুনাহের কাজকে বর্জন করা। আর ইস্তিগফার অর্থ কৃত পাপের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে উত্তম জীবন সামগ্রী দান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তানাদি বাড়িয়ে দেবেন”(সূরা নূহ, ৭১/১০-১২)।
(৩).আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা। আল্লাহ তা‘আলার উপর পূর্ণাঙ্গ ভরসা ও আস্থা রাখা। কেননা একমাত্র তিনিই রুযির একচ্ছত্র মালিক সেমর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রিযিকের দায়ভার গ্রহণ করবেন। উমার রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর উপর প্রকৃতভাবে ভরসা করতে পারো তাহলে, তিনি তোমাদেরকে পাখির ন্যায় রিযিক দান করবেন। অর্থাৎ পাখি যেমন খালি পেটে সকালে বের হয় সন্ধায় ভর্তি পেটে ফিরে আসে (মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৫; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৬৪)।
(৪).আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা:ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রুযিতে বারাকাত দান করবেন।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِيْ لَشَدِيْدٌ- ‘যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হ’লে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিব, আর অকৃতজ্ঞ হ’লে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর”।(সূরা ইবরাহীম ১৪/৭
(৫).বেশি বেশি দান করা। দান সদকার ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ও তাঁর সম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে নেবেন।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَمْحَقُ اللّهُ الْرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللّهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ- ‘সূদকে আল্লাহ মিটিয়ে দেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না”।(বাক্বারাহ ২/২৭৬)।
(৬).আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা।আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা সম্পদ বৃদ্ধির উপায়। আত্মীয় হ’ল যাদের আপসে বংশীয় সম্পর্ক আছে, তাতে তারা একে অপরের ওয়ারিছ হোক অথবা না হোক, তাদের আপসে বিবাহ বৈধ হোক না হোক। আত্মীয়তার অধিকার রক্ষা করা এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখার ফলস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রুযিতে প্রশস্ততা দান করবেন। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে বলেছেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِيْ رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِيْ أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি পসন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে’ (সহীহ বুখারী, হা/২০৬৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৭)।
(৭).বিবাহ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِيْنَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُوْنُوْا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ‘আইয়িম’ (বিপত্নিক পুরুষ বা বিধবা স্ত্রী) তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও; তারা অভাবগ্রস্ত হ’লে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’ (নূর ২৪/৩২)। এই আয়াত প্রমাণ করে আনুগত্যশীল যুবক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিবাহ করলে আল্লাহ তাকে ধনী করবেন।এর তাফসীরে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, التمسوا الغنى فى النكاح ‘বিবাহর মাধ্যমে সম্পদ অন্বেষণ কর। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা তিন প্রকারের মানুষকে সাহায্য করা নিজের কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদকারী, মুকাতাব গোলাম- যে চুক্তির অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা করে এবং বিবাহে আগ্রহী লোক যে বিবাহের মাধ্যমে পবিত্র জীবন যাপন করতে চাই (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৯; মুসনাদে বাযযার, হা/৮৫০০)।
(৮).দুর্বল ও অসহায়ের প্রতি সহযোগিতা, সহানুভূতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করা: কেননা দুর্বলদের ইখলাছ, ইবাদত ও দু‘আর কারণেই পৃথিবীবাসী এখনো রিযিকপ্রাপ্ত এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হচ্ছে (সূরা আর-রহমান : ৬০) গরীবদের সহায়তা করলে রিযক বৃদ্ধি পায়। রাসূল ﷺ) বলেছেন,عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ رَأَىَ سَعْدٌ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ لَهُ فَضْلاً عَلَى مَنْ دُوْنَهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلاَّ بِضُعَفَائِكُمْ،মুছ‘আব বিন সা‘দ হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, সা‘দ মনে করতেন যে, গরীব ও দুর্বলদের উপর তাঁর মর্যাদা আছে। সেজন্যে রাসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা সাহায্য ও রিযক প্রাপ্ত হয়ে থাক তোমাদের মধ্যে যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের কারণে।(সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০৫ হা/২৮৯৬; নাসাঈ, হা/৩১৭৮)।
(৯).বেশি বেশি দু‘আ করা। হালাল রিযিকের জন্য নিম্নোক্ত দু‘আগুলো পড়া যেতে পারে- ১. اللَّهُمَّ اكْفِنِى بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِى بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ তথা; হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হারাম ছাড়া হালাল দ্বারা যথেষ্ট করুন এবং আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে অন্যদের হতে মুখাপেক্ষীহীন করুন (তিরমিযী, হা/৩৯১১; সিলসিলা সহীহা, হা/২৬৬)। ২. اللهم أَغْنِنَا بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنَا مِنْ فَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ তথা ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের আপনার হালালের মাধ্যমে হারাম থেকে মুক্ত রাখুন এবং আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদের অন্যদের হতে মুখাপেক্ষীহীন করুন’ (জামেউল আহাদীস, হা/২৭৪২৩)। ৩. اللهم إِنِّىْ أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً তথা ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী ইলম, পবিত্র রিযিক্ব এবং গ্রহণীয় কর্ম কামনা করি (ইবনু মাজাহ, ৯২৫; মিশকাত, হা/২৪৯৮;সিলসিলা সহীহা, হা/১৫১১)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ইসলামে রয়েছে সম্পদ বৃদ্ধির উত্তম উপায় সমূহ। সেই উপায় সমূহ যদি মানুষ অনুশীলন করে তাহ’লে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সমৃদ্ধি নেমে আসবে। অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পাবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে।আসুন,আমরা ইসলামী উপায়ে নিজেদের উপার্জন বৃদ্ধিতে অগ্রগামী হই।ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, চারটি জিনিস রিযিক নিয়ে আসে। (১) রাতজেগে ইবাদত করা; (২) শেষ রাতে ইস্তিগফার করা; (৩) সাদাকাহ প্রদান করা এবং (৪) দিনের শুরু ও শেষে (সকাল-সন্ধ্যায়) যিকর করা।(ইমাম ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৭৮)। আল্লাহ আমাদের সবার রিযক ও সম্পদে বরকত দান করুন। আমীন!!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
__________________________
উপস্থােনায়,জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)
শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।