প্রশ্ন: হাদীসের অর্থ (অহংকার আমার চাঁদর এবং মহত্ত্ব আমার লুঙ্গি) এর ব্যাখ্যা কি? আল্লাহর কি চাঁদর ও লুঙ্গি সিফাত আছে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ হল আল্লাহ তা‘আলাকে ঐ গুণে গুণান্বিত করা যে গুণে আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন। সেগুলোর কোনরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, অপব্যাখ্যা, সাদৃশ্যদান, ধরন বর্ণনা ও নিস্ক্রীয়করণ ছাড়া যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস ও গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে থাকেনা। যেমন একটি মূলনীতি হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফিয়্যাহ তথা বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর। কুরআন ও হাদিসের দলীল ছাড়া আল্লাহর জন্য কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা যাবে না। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর যেসব গুণের উল্লেখ রয়েছে তাঁর জন্য শুধু সে গুণগুলো সাব্যস্ত করতে হবে এবং কোন মাখলুকের সাথে আল্লাহর গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যতাকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে হবে। যেহেতু আল্লাহ নিজেই বলেছেন- لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُঅর্থ- “তাঁর মত কিছুই নেই,তিনি হচ্ছে সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”[সূরা শুরা, আয়াত: ১১] .
দ্বিতীয়ত: এবার হাদীসটির ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। প্রখ্যাত সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,الْعِزُّ إِزَارُهُ، وَالْكِبْرِيَاءُ رِدَاؤُهُ، فَمَنْ يُنَازِعُنِي عَذَّبْتُهُ “শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর (আল্লাহর) লুঙ্গী এবং অহংকার তাঁর চাঁদর। যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঝগড়ায় অবতীর্ণ হবে আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দিব।[সহীহ মুসলিম হা/২৬২০] অপর বর্ননায় আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي ، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন: “অহংকার আমার চাদর এবং বড়ত্ব আমার লুঙ্গী” সুতরাং যে ব্যক্তি এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে কাড়াকাড়ি করবে তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করব”। [আবু দাউদ হা/ ৪০৯০]
.
মুসলিমের হাদীসের ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,هكذا هو في جميع النسخ ، فالضمير في ” ازاره ” ، ” ورداؤه ” : يعود إلى الله تعالى للعلم به ، وفيه محذوف تقديره : ” قال الله تعالى : ومن ينازعني ذلك أعذبه ” .ومعنى ” ينازعني ” : يتخلق بذلك فيصير في معنى المشارك .وهذا وعيد شديد في الكبر مصرح بتحريمه “সহিহ মুসলিমের সব কপিতে এভাবে আছে। ازاره ও رداؤه শব্দদ্বয়ের ه জমির (সর্বনাম) দ্বারা আল্লাহকে বুঝানো হচ্ছে। এখানে বাক্যের কিছু অংশ উহ্য রয়েছে সেটা হচ্ছে-قال الله تعالى : ومن ينازعني ذلك أعذبه (অর্থ- আল্লাহ বলেন: যে ব্যক্তি সেটা নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে আমি তাকে শাস্তি দিব) আমার সাথে ‘টানাটানি’ করবে এর অর্থ এ গুণ লালন করবে; ফলে সে অংশীদার এর পর্যায়ে পড়বে। এটি অহংকারের কঠিন শাস্তি ও অহংকার হারাম হওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা।(নববী শারহু মুসলিম; খন্ড: ১৬; পৃষ্ঠা:১৭৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুণ হল: অহংকার ও বড়ত্ব। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মর্যাদা ও বড়ত্বের জন্য যেভাবে শোভনীয় সেভাবেই। অপরদিকে: হাদীসে رِدَائِي এবং إِزَارِي তথা লুঙ্গি ও চাদর- শব্দ দু’টি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উভয়টি সিফাতের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং এটা দ্বারা উদ্দেশ্য যে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা যিনি মর্যাদাবান সম্মানিত এবং বড়ত্ব ও অহংকারের গুণে গুণান্বিত। কোনো ব্যক্তি যেন এর একটি নিয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়ায় অবতীর্ণ না হয়। যেমনিভাবে লুঙ্গি এবং জামা উভয়টি পোষাকের জন্য নির্দিষ্ট, যার ব্যাপারে কেউ বিতর্ক করে না।এছাড়াও, কিবরিয়া তথা অহংকার একটি পর্দা যা আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলাকে দেখতে বাধা দেয়, ঠিক যেমনিভাবে পোশাক বাধা দেয় তা দেখা থেকে যা চাদরে দিয়ে আবৃত রাখা হয়। অনুরূপ ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যা আবু বকর ইবন আব্দুল্লাহ ইবন কায়স হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:جَنَّتَانِ مِنْ فِضَّةٍ آنِيَتُهُمَا، وَمَا فِيهِمَا، وَجَنَّتَانِ مِنْ ذَهَبٍ آنِيَتُهُمَا، وَمَا فِيهِمَا، وَمَا بَيْنَ الْقَوْمِ وَبَيْنَ أَنْ يَنْظُرُوا إِلَى رَبِّهِمْ ، إِلَّا رِدَاءُ الْكِبْرِيَاءِ عَلَى وَجْهِهِ فِي جَنَّةِ عَدْنٍ “(জান্নাতে) দুটি উদ্যান থাকবে। এই দুটির সকল পাত্র এবং এর অভ্যন্তরের সকল বস্তু রূপার তৈরি হবে। (জান্নাতে) আরও দুটি উদ্যান থাকবে। এই দুটির সকল পাত্র এবং এর অভ্যন্তরের সকল বস্তু সোনার তৈরি হবে। জান্নাতে-আদনের মধ্যে জান্নাতবাসীরা তাদের রবকে দেখবে। জান্নাতবাসী এবং তাদের রবের এই দর্শনের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার চেহারার উপর অহংকার তথা বড়ত্বের চাদর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না”।(সহীহ মুসলিম হা/১৮০)
.
আর হাদীসে চাঁদর ও লুঙ্গি উল্লেখের তাৎপর্য এই নয় যে,আল্লাহ সুবহানা তায়ালার চাঁদর এবং লুঙ্গি রয়েছে যা তিনি পরিধান করে থাকেন। এ বিষয়ে মুহাক্কীককদের মতামত রয়েছে। যেমন:
(১).ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন;
معنى هذا الكلام أن الكبرياء والعظمة صفتان لله سبحانه ، اختص بهما ، لا يشركه أحد فيهما ، ولا ينبغي لمخلوق أن يتعاطاهما، لأن صفة المخلوق التواضع والتذلل .وضرب الرداء والإزار مثلاً في ذلك ؛ يقول – والله أعلم – : كما لا يشرك الإنسانَ في ردائه وإزاره أحدٌ ؛ فكذلك لا يشركني في الكبرياء والعظمة مخلوق . والله أعلم”
“উক্ত কথা দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, “অহংকার ও বড়ত্ব” আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুনাগুন। যা একমাত্র তাঁর (আল্লাহর) জন্যই নির্দিষ্ট। উভয় দুইটি মাঝে কারও অংশীদারিত্ব নেই। সুতরাং উক্ত গুণ-দুটিকে গ্রহণ করা কোনো মাখলুকের জন্য কখনোই উচিত না। কারণ মাখলুকের গুণ হল বিনয়, নম্রতা অবলম্বন করা এবং আল্লাহর কাছে অবনত হওয়া।(হাদিসে কুদসিতে) আল্লাহ তা‘আলা উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে পোষাকের কথা উল্লেখ করেছেন এ জন্য যে, মানুষ যেমন তার লুঙ্গি, জামার সাথে কাউকে শরীক তথা অংশীদার করে না। তেমনি তাঁর গুণাবলীর সাথে কোন মাখলুকের অংশীদারিত্ব নেই।আর এ বিষয়ে আল্লাহ ভালো জানেন। (মাআলিমুস সুনান; খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ১৯৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন;
قال الرازي: الوجه التاسع: قال صلى الله عليه وسلم: (الكبرياء ردائي والعظمة إزاري). والعاقل لا يثبت لله تعالى إزارًا ورداء.
فيقال: هذا الحديث في الصحيح رواه مسلم أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (يقول الله عز وجل: العظمة إزاري والكبرياء ردائي فمن نازعني واحدًا منهما عذبته) وقد ورد أيضًا: (سبحان من تقمص بالعز ، ولاق به) .وليس ظاهر هذا الحديث أن لله إزارًا ورداء ، من جنس الأزر والأردية التي يلبسها الناس ، مما يصنع من جلود الأنعام ، والثياب كالقطن والكتان ؛ بل الحديث نص في نفي هذا المعنى الفاسد، فإنه لو قال عن بعض العباد : إن العظمة إزاره ، والكبرياء رداؤه : لكان إخباره بذلك عن العظمة والكبرياء ، اللذين ليسا من جنس ما على ظهور الأنعام ، ولا من جنس الثياب ما يبيّن ويظهر أنه ليس المعنى : أن العظمة والكبرياء هما إزار ورداء ، بهذا المعنى.فإذا كان المعنى الفاسد لا يظهر من وصف المخلوق بذلك؛ لأن تركيب اللفظ يمنع ذلك، ويبين المعنى الحق ؛ فكيف يدعي أن هذا المعنى ظاهر اللفظ في حق الله تعالى، الذي يعلم كل مخاطب أن الرسول صلى الله عليه وسلم ، لم يخبر عنه بلبس الأكسية وثياب القطن والكتان ، التي يُحتاج إليها لدفع الحر والبرد ، وستر العورة.وهذا أقبح ممن يزعم أن قوله: (إن خالدًا سيف من سيوف الله ، سلَّه الله على المشركين) : أن ظاهره أن خالدًا من حديد .وأقبح ممن يزعم أن قوله عن الفرس: (إن وجدناه لبحرًا) : ظاهره أن الفرس ماء كثير، ونظائر هذا كثيرة.
وإذا كان هذا المعنى الفاسد ليس ظاهر الحديث، بل نص الحديث – الذي هو أبلغ من مجرد الظاهر – : ينافيه ؛ كان ما ذكره باطلاً “.إلى أن قال: ” والكبرياء والعظمة : لا تصلح إلا لله رب العالمين ، الرب الخالق الباري الغني الصمد القيوم، دون العبد المخلوق الفقير المحتاج.والكبرياء فوق العظمة، كما جعل ذلك رداء وهذا إزارًا…وهما [أي العظمة والكبرياء] ، مع أنهما لا يصلحان إلا لله : فيمتنع وجود ذاته بدونهما ، بحيث لو قدر عدم ذلك ، للزم تقدير المحذور الممتنع من النقص والعيب في ذات الله، فكان وجودهما من لوازم ذاته ، وكمالها التي لا ينبغي أن تعرى الذات وتتجرد عنها، كما أن العبد لو تجرد عن اللباس ، لحصل له من النقص والعيب بحسب حاله ، ما يوجب أن يحصل له لباسًا. وأيضًا : فاللباس يحجب الغير عن المشاهدة لبواطن اللابس ، وملامستها ؛ وكبرياء الله وعظمته تمنع العباد من إدراك البصر له ، ونحو ذلك، كما في الحديث الصحيح الذي في صحيح مسلم عن أبي موسى عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال: (جنات الفردوس أربع ، ثنتان من ذهب ، آنيتهما وحليتهما وما فيهما ، وثنتان من فضة آنيتهما وحليتهما وما فيهما ، وما بين القوم وبين أن ينظروا إلى ربهم إلاَّ رداء الكبرياء على وجهه في جنة عدن).فهذا الرداء الحاجب ، الذي قد يكشفه لهم ، فينظرون إليه : سماه رداء الكبرياء ؛ فكيف ما يمنع من إدراكه وإحاطته ؛ أليس هو أحق بأن يكون من صفة الكبرياء”
“ফখরুদ্দীন আর-রাযী (আল্লাহর গুণ সাব্যস্ত করার ওপর আপত্তি করে) বলেছেন: নবম কারণ হচ্ছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “অহংকার আমার চাদর এবং ইয্যত সম্মান আমার লুঙ্গী”। আর আহালুল ইমামগন কখনো আল্লাহর জন্য চাদর এবং লুঙ্গী সাব্যস্ত করতে পারে না। ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ উত্তরে বলেন, তাকে বলা হবে যে, উক্ত হাদিসটি বিশুদ্ধ যা ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন: “অহংকার আমার চাদর এবং বড়ত্ব আমার লুঙ্গী।(অর্থাৎ খাস আমার গুণ) সুতরাং যে এর কোনো একটি নিয়ে আমার সাথে কাড়াকাড়ি করবে তাকে আমি শাস্তি দিব।”এটিও বর্নিত আছ,পবিত্রময় তিনি যিনি গৌরব গ্রহণ করেন এবং তিনি এর যোগ্য।বস্তুত এই হাদিসের প্রকাশ্য অর্থ এই নয় যে,আল্লাহ তা‘আলার জন্য লুঙ্গী এবং চাদর রয়েছে যেমনটা মানুষ পরিধান করে থাকে, যা কিনা চামড়া, তুলা বা সুতা থেকে তৈরি করা হয়। বরং উক্ত হাদিসই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, মানুষের পরিধেয় বস্ত্রের মত তাঁর চাদর বা লুঙ্গী নয়। কেননা যদি কোনো মানুষ বলে ‘অহংকার আমার চাদর, ইয্যত আমার লুঙ্গী’ তাহলে তার কথা দ্বারা অন্য মানুষ এটাই বুঝবে যে লোকটি তার গৌরব এবং ইজ্জতের জানান দিচ্ছে। তার ঐ চাদর এবং লুঙ্গী চামড়া, তুলা বা সুতা নির্মিত নয়। বরং গৌরব এবং ইয্যতই হলো তার চাদর এবং লুঙ্গী। এটাই এ লোকের বক্তব্যের সঠিক ও প্রকাশ্য অর্থ। তাই যখন উক্ত বাতিল অর্থটি মানুষের গুণ হিসেবেও সে ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা যায় না (এ কারণে যে শব্দের বিন্যাস তা করতে বাধা দেয় বরং শব্দের বিন্যাস, পূর্বাপর বর্ণনা সেটির সঠিক অর্থ প্রকাশ করে) তখন কীভাবে এটা দাবী করা যাবে যে, উক্ত বাতিল অর্থটি শব্দের প্রকাশ্য অর্থ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার শানে প্রয়োগ হবে?? অথচ প্রতিটি মানুষ তথা যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তারা জানে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড় পরিহিত আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে জানান দেননি। যা কিনা গরম, শীত বা লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য প্রয়োজন হয়ে থাকে।এ ধরনের দাবী ঐ কথা থেকেও নিকৃষ্ট, যারা দাবি করে যে “খালিদ ইবন ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু আল্লাহ তা‘আলার তরবারীর মধ্য থেকে একটা তরবারী, যা আল্লাহ তা‘আলা কোষমুক্ত করেছেন মুশরিকদের ওপর” এর যাহের বা প্রকাশ্য অর্থ হচ্ছে, খালিদ ইবন ওলীদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু লোহার তৈরী! অনুরূপ; তাদের এ দাবী এ কথা থেকেও মন্দ, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আবু ত্বালহার ) ঘোড়ার ব্যাপারে বলেছেন, “ঘোড়াটি তো দেখছি সমুদ্রবৎ” এখানে শব্দের যাহের বা প্রকাশ্য অর্থ, ঘোড়ার মধ্যে অনেক পানি রয়েছে। এমন বহু উদাহরণ রয়েছে!! সুতরাং এটি স্পষ্ট হলো যে বাতিল অর্থ কখনো হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ হতে পারে না। বরং হাদীসের ভাষ্য স্বয়ং বাতিল অর্থ গ্রহণকে নিষেধ করে।…অবশেষে ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘অহংকার ও বড়ত্ব’ এ দু’টি কেবল রাব্বুল আলামীন এর জন্যই উপযোগী, যিনি পালনকারী, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, অভাবমুক্ত, অমুখাপেক্ষী, সর্বসত্তার রক্ষক। এ গুণ দু’টি বান্দা, সৃষ্ট, অভাবী, মুখাপেক্ষী কারও জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।আর তাঁর অহংকার গুণটা তাঁর মহত্ব গুণের চেয়ে বড়, যেমনিভাবে তিনি অহঙ্কারকে চাদর আর মহত্বকে লুঙ্গী বলে ব্যক্ত করেছেন। এ দু’টি [অহংকার ও বড়ত্ব] গুণ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত অন্য কারো জন্য উপযোগী নয়। সুতরাং উক্ত গুণ দু’টি ছাড়া তাঁর সত্তার অস্তিত্ব অসম্ভব, এমনভাবে যে, যদি তাঁর সত্তাকে ঐ দু’টি গুণ শুন্য স্থির করা হয় তবে আল্লাহ তা‘আলার সত্তায় ভয়াবহ নিষিদ্ধ দোষ-ত্রুটি, কমতি আপতিত হওয়া আবশ্যক হয়ে যাবে। সুতরাং এ দু’টি গুণ তাঁর সত্তার জন্য এমনিভাবে আবশ্যক এবং তাঁর সত্তার পূর্ণতার জন্য এতই বাঞ্ছনীয় যে, কোনোভাবেই সত্তাকে তা থেকে মুক্ত কিংবা শূণ্য করা যাবে না। যেমনিভাবে কোনো ব্যক্তি যদি কাপড় থেকে মুক্ত হয়ে যায় তবে অবস্থা অনুযায়ী তার ওপর দোষ-ত্রুটি ও অপূর্ণতা অর্জিত হবে; যা বাধ্য করে যে, তার একটি পোষাক থাকবে।তাছাড়া, কাপড় সাধারণত পরিধানকারীর ভিতর দেখা এবং স্পর্শ করা হতে অপরকে বাধা দেয়। আল্লাহ তা‘আলার অহংকার ও বড়ত্ব বান্দা কর্তৃক তাকে চাক্ষুষভাবে আয়ত্ব করা ও অনুরূপ কিছু থেকে বাধা প্রদান করে। এমনটিই বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে, যা ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ আবু মুসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; জান্নাতুল ফিরদাউস হলো চারটি: “দু’টি হবে স্বর্ণের: এ দু’টির সকল ভূষণ, পাত্র এবং এর ভিতরে সকল বস্তু স্বর্ণের (তৈরী হবে)। এবং আরো দু’টি থাকবে রূপার: এ দু’টির সকল ভূষণ, পাত্র এবং ভিতরের সকল বস্তু (রৌপ্য নির্মিত হবে)। জান্নাতু আদনে এর অধিবাসী এবং তাদের প্রতিপালকের দর্শনের মাঝে আল্লাহর তা‘আলার চেহারার ওপর তাঁর (কিবরিয়া) অহংকারের চাদর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।আর এটাই সে আড়ালকারী চাদর, যা তিনি তাদের (জান্নাতীদের) জন্য উন্মোচন করে দিবেন অতঃপর তারা তাঁর দিকে তাকাবে। এজন্য তিনি অহংকারের চাদর নামে নামকরণ করেছেন। তাহলে সেটার ব্যাপারে কী ধারণা, যা তাঁকে আয়ত্ব ও পূর্ণরূপে ধারণ করতে বাধা প্রদান করে? এটাই কি অহংকার গুণে হওয়ার বেশি যোগ্য নয়? (বায়ানু তালবিসিল জাহমিয়্যাহ; খন্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ২৭০-২৭৭)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে প্রশ্ন করা হয়েছে: ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”আল্লাহ তাআলা বলেন, সম্মান আমার লুঙ্গি এবং গর্ব আমার চাদর (অর্থাৎ খাস আমার গুণ) সুতরাং যে ব্যক্তি আমার কাছ থেকে এর মধ্য থেকে যে কোন একটি টেনে নিতে চাইবে, আমি তাকে শাস্তি দেব। কিভাবে আমরা এ হাদিসটি বুঝবো? লুঙ্গি এবং চাদর আল্লাহ তায়ালার সাথে কি সম্পর্কিত করা জায়েজ? এটাই স্পষ্ট করার জন্য কি ব্যাখা আবশ্যক?
উত্তরে তারা বলেন:
قال الخطابي – رحمه الله تعالى- في شرحه لـ (سنن أبي داود) : معنى الحديث: أن الكبرياء والعظمة صفتان لله سبحانه، اختص بهما لا يشركه أحد فيهما، ولا ينبغي لمخلوق أن يتعاطاهما؛ لأن صفة المخلوق التواضع والتذلل، وضرب الرداء والإزار مثلا في ذلك. يقول- والله أعلم- كما لا يشرك الإنسان في ردائه وإزاره أحد، فكذلك لا يشركني في الكبرياء والعظمة مخلوق. والله أعلم..”
ইমাম খাত্তাবী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থ সুনানে আবী দাউদে বলেছেন; হাদিসের অর্থ; অবশ্যই “অহংকার ও বড়ত্ব” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলার দু’টি গুণ যা একান্তই তাঁর নিজস্ব,যা অন্য কারো সাথে গুণ দু’টির অংশিদারিত্ব নেই। উক্ত গুণ দুটিকে গ্রহণ করা কোনো মাখলুকের জন্য কখনোই উচিত না। কারণ মাখলুকের গুণ হল বিনয়, নম্রতা অবলম্বন ও অবনত হওয়া। এটা বুঝানোর জন্যই “লুঙ্গী এবং চাদরের” উদাহরণ দিয়েছেন এ জন্য যে, মানুষ যেমন তার লুঙ্গি, জামার সাথে কাউকে শরীক করে না। অনুরূপ অহংকার ও বড়ত্বে আমার সাথে কোনো মাখুলুকের শরীক নেই। আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ভালো জানেন। আল্লাহ তায়ালার সাহায্য কামনা করছি। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তার পরিবার এবং তার সকল সাহাবীদের উপর রহমত বর্ষিত হোক।(ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৯৯)
.
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুল মুহসিন আল-‘আব্বাদ আল-বাদর (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৩ হি./১৯৩৪ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: হাদিসে কুদসীতে রয়েছে: “অহংকার আমার চাদর এবং মহত্ত্ব আমার লুঙ্গি ” এর দ্বারা লুঙ্গি এবং চাদরকে আল্লাহ্ তা’আলার সিফাত হিসেবে গন্য করা যাবে কি:
উত্তরে তিনি বলেন;
” لا، هذا لا يثبت منه صفه الإزار ولا الرداء، وإنما هذا فيه بيان اختصاص الله عز وجل واتصافه بهما، يعني: مثلما أن الإنسان يستعمل الإزار والرداء، فالله عز وجل موصوف بالكبرياء والعظمة وهما إزاره ورداؤه، لكن لا يقال: إن من صفات الله الإزار أو الرداء، وإنما يقال: العظمة والكبرياء إزاره ورداؤه .وهذا من جنس قول الرسول صلى الله عليه وسلم في الأنصار: “الأنصار شعار، والناس دثار”، معناه: قربهم منه، والتصاقهم به كالتصاق الشعار بالإنسان، والناس الذين وراءهم مثل الثوب. فالمقصود من ذلك التشبيه، وليس المقصود من ذلك أن الله عز وجل له إزار ورداء، وأن من صفاته الإزار والرداء، وإنما اختص الله عز وجل بالعظمة والكبرياء، وأنه اتصف بهما، وأنه لا يشاركه فيهما أحد .فهذا هو الذي يوصف الله تعالى به، ولكن لا يجوز أن يقال: إن الله عز وجل من صفاته الإزار، ومن صفاته الرداء .ويوضح ذلك حديث: “الأنصار شعار، والناس دثار”، ومعلوم أن الأنصار ليسوا شعاراً، وإنما هذا تشبيه لقربهم منه، والتصاقهم به، كما يحصل من الشعار الملاصق بالجسد، فالأنصار مثل الشعار، وغيرهم كالدثار، وهو الذي وراء الشعار” انتهى من:
না..এটা প্রমাণ করে না যে, লুঙ্গী এবং চাদর আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুণ। বরং এ দুটি দ্বারা অহংকার এবং বড়ত্ব গুণ আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হওয়াকে শক্তিশালী করে। অর্থাৎ; উদাহরণস্বরূপ মানুষ লুঙ্গী এবং চাদর ব্যবহার করে, আর আল্লাহ ত‘আলা “অহংকার ও বড়ত্ব” গুণে গুণান্বিত এবং এই দু’টি গুণই তাঁর চাদর এবং লুঙ্গী। কিন্তু এটা বলা যাবে না যে, চাদর এবং লুঙ্গী আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুণের মধ্য থেকে দু’টি গুণ। বরং বলা হবে, “বড়ত্ব ও অহংকার” তাঁর ‘লুঙ্গী’ ও ‘চাদর’।আর এটি আনসারদের সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তারই অনুরূপ; তিনি বলেছিলেন,“আনসারগণ হচ্ছে (নবীর) ভিতরের পোশাক (যে পোষাক শরীরের সাথে লেগে থাকে) আর অন্যান্য লোক হচ্ছে উপরের পোশাক”, যার অর্থ; তাঁরা ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’এর অধিক নিকটতম। তাঁরা তাঁর আনুগত্যে এমন ভাবে লেগে থাকত যেমনটা ভিতরের পোষাক শরীরের সাথে লেগে থাকে। আর সাধারণ মানুষ যারা তার পিছে থাকত তাদের উপমা হলো কাপড়ের মত। সুতরাং এখানে শুধুমাত্র সাদৃশ্যই উদ্দেশ্য, এটা উদ্দেশ্য নয় যে, আল্লাহ তা‘আলার লুঙ্গী ও চাদর রয়েছে যা তাঁর সিফাত বা গুণ। “অহংকার ও বড়ত্ব” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলার দু’টি গুণ যা একান্তই তাঁর নিজস্ব, কারো সাথে গুণ দু’টির অংশিদারিত্ব নেই। তাই একথা বলা কখনোই জায়েয হবে না যে, লুঙ্গী ও চাদর তাঁর সিফাত।(দেখুন رابط المادة: http://iswy.co/e44b7)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, অহংকার এবং মহত্ত্ব আল্লাহ তাআলার সত্ত্বাগত সিফাত তথা গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। এগুলি তাঁর সত্তার জন্য অপরিহার্য। তাই কোনো মানুষের জন্য কখনোই এ কথা বলা জায়েয নয় যে তিনি এ দুটার দ্বারা গুণান্বিত ছিলেন না অথবা তিনি উক্ত গুণ দু’টিতে পরবর্তীতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বস্তুত উক্ত হাদিসে আলোচিত শব্দ “লুঙ্গী এবং চাদর” দুটিকে তাঁর জন্য “অহঙ্কার” ও “বড়ত্ব” গুণাবলী দু’টি বিশেষভাবে নির্দিষ্টকরণের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। আরো নিয়ে আসা হয়েছে এটা বুঝানোর জন্য যে, অহংকারের চাদর তাঁকে দেখা হতে বাধা হয়ে আছে। সুতরাং অহংকার এমন একটি গুণ যা শুধু আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ গুণ নিয়ে আল্লাহর সাথে টানাটানি করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন, তার প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন। (আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।